সারিয়াকান্দি উপজেলা

বগুড়ায় মিশ্র ফল-সবজির প্রকল্পে কৃষি কর্মকর্তার নয়-ছয়ের অভিযোগ

সারিয়াকান্দি (বগুড়া) প্রতিনিধি: বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মিশ্র ফল ও সবজির বাগান প্রদর্শনী প্রকল্পের টাকা নয়-ছয় করার অভিযোগ উঠেছে। মাঠ পর্যায়ে খোঁজ নিয়েও এসব অনিয়মের সত্যতা পাওয়া গেছে।


প্রকল্পের তালিকাভুক্ত কৃষকরা বলছেন, প্রকল্পের বরাদ্দে থাকলেও অনেক প্রয়োজনীয় সুবিধা তারা পাননি। অথচ বাগান শুরুতেই সেই সহায়তা দেয়ার কথা। যদিও অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করছেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ।


সারিয়াকান্দি উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সালে বগুড়ায় স্মলহোল্ডার এগ্রিকালচার কম্পিটিটিভনেস প্রজেক্ট (এসএসিপি-রেইনস) প্রকল্পের আওতায় মিশ্র ফল ও সবজী বাগান প্রদর্শনী প্লটের উদ্যোগ নেয়া হয়। এই প্রকল্পটিতে যৌথ অর্থায়ন করছে ইফাদ ও জিএএফপি।


প্রকল্প অনুযায়ী সারিয়াকান্দির ১২ ইউনিয়নে ১৪ টি মিশ্র ফল ও সবজী বাগান প্রদর্শনী দেওয়া হয়। এর মধ্যে ১১ টি পেঁপে ও ৩ টি বাগানে কলা চাষের অনুমোদন দেয় উপজেলা কৃষি অফিস। বাগানে মিশ্র সবজি হিসেবে লাল শাক বা মিষ্টি কুমড়া থাকবে।


প্রতিটি প্রদর্শনী প্লটের পরিমাণ নির্ধারণ এক একর (একশ শতক) করা হয়। ১৪ টি প্রদর্শনী প্লটের বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয় ৮ লাখ ৪০ হাজার টাকা। প্রতিটি প্রদর্শনীর ব্যয় ধরা হয় ৬০ হাজার টাকা।


কলার চাষের ক্ষেত্রে প্রকল্পের আওতায় গর্ত তৈরী বাবদ বরাদ্দ দেয়া হয় ৬ হাজার টাকা। এ ছাড়া চারার জন্য ৮ হাজার, রাসায়নিক সার ৪২৫০ জৈব সার ৪৫০০, জমির সীমানা নির্ধারণ বাঁশের খুঁটি ৪ হাজার, বেড়া ও শ্রমিক ৯ হাজার, সেচ পলি মালচিং ৮ হাজার, আন্তঃফসল লাল শাক ৬ হাজার, পরিবহন ২ হাজার, পেস্টিসাইড দমন ২ হাজার,
পেঁপে চাষে জমি তৈরী ৬ হাজার, চারা ৬ হাজার, রাসায়নিক সার ৪২৫০ জৈব সার ৪৫০০, স্পেয়ার ওয়াটারিং ৫ হাজার, বেড়া ও শ্রমিক ৮ হাজার, সেচ পলি মালচিং ৮ হাজার, সাথী ফসল মিষ্টি কুমড়ার বীজ ৬ হাজার, বায়ো পেস্টিসাইড ৫ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়।


এ ছাড়া দুই ফসলের জন্য রেজিস্ট্রার ২৫০, সাইন বোর্ড টিনের ১ হাজার মার্কেটিং ৪ হাজার এবং অন্যান্য ১ হাজার বরাদ্দ দেয়া আছে।
অনুসন্ধান বলছে, ১৪ টি প্রদর্শনীতে কৃষকরা পেয়েছেন মাত্র ১ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা। বাকি টাকা চলে গেছে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার পকেটে। মিশ্র ফল প্রকল্পের তালিকা ধরে উপজেলার হাটশেরপুর, নারচী, চন্দনবাইশা ইউনিয়নে বাগানগুলো ঘুরে এসব দেখা হয়।


এসব বাগান ঘুরে দেখা যায়, কোনো প্লটই এক একর জমিতে স্থাপন করা হয়নি। এ ছাড়া প্রকল্পের নিয়ম অনুযায়ী সাইনবোর্ড দেয়ার কথা টিনের। কিন্তু বাগানগুলো ঘুরে দেখা গেছে প্লাস্টিক পেপার (প্যানা) দিয়ে প্রদর্শনী সাইনবোর্ড স্থাপন করা হয়।


কৃষকরা বলছেন, ৬০ হাজার টাকার বরাদ্দে কৃষকদের দেওয়া হয়েছে গড়ে মাত্র ১০ হাজার টাকা। অফিস থেকে ৫০ কেজি ওজনের ২ বস্তা জৈব সার, ৩০ কেজি ইউরিয়া, ৩০ কেজি এমওপি, ২৫ কেজি ডিএপি, ২০ কেজি ২ টি নেট আর ২ টি ছোট প্যাকেট ও বোতল ওষুধ দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের নিয়ম অনুযায়ী চারা কৃষি অফিস থেকে দেয়ার কথা। কিন্তু সব চারা নিজেদের কিনতে হয়েছে। সেচ-মালচিং, নিরাপওার জন্য বাঁশ, স্প্রেয়ার ও ওয়াটারিং জার এসবের কিছুই এখনও দেয়া হয়নি। অনেকের বাগানে শুধু সাইনবোর্ড দেয়া আছে, আর কিছুই দেয়া হয়নি।
কৃষকরা দাবি করছেন, বাগান স্থাপনের সময় দেখানো হয়েছে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে। কৃষি অফিসের কাগজে কলমে চলতি বছরের ৮ থেকে ১৫ জানুয়ারি সময়ে গাছ রোপন দেখানো হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে গাছ রোপন হয়েছে ২০ ফেব্রুয়ারির পর থেকে।


এই প্রকল্পে হাটশেরপুর ইউনিয়নের তাজুরপাড়া গ্রামের কৃষক নিয়াইল ভিউল হাসান প্রিন্স প্রদর্শনীর বরাদ্দ পেয়েছেন। তিনি প্রকল্পের আওতায় ৫০ শতক জমিতে পেঁপে ও মিষ্টি কুমড়া চাষ করেছেন।
তিনি জানান, প্রদর্শনীতে সব ধরনের সহায়তা করার কথা থাকলেও আমরা সব সহায়তা পাইনি। ছয় মাসের প্রদর্শনীর মধ্যে এরই মধ্যে দুই মাস চলে গেছে।


খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, অধিকাংশ কৃষক প্রকল্পটি সম্পর্কে তেমন কিছু জানেন না। তেমনই একজন নারচী ইউনিয়নের গোদাগাড়ী কৃষাণী মোছা. রিতা বেগম। তিনি বলেন, আমি মিশ্র ফল ও সবজী বাগান প্রদর্শনী করেছি। আমাকে কৃষি অফিস থেকে জৈব সার, রাসায়নিক সার, নেট এগুলোই দিছে। এ ছাড়া কোনও কিছু অফিস থেকে দেয়নি। একটা কাগজে সই নিছে, কিবেন দিবি পরে, সে বিষয়ে কিছু বলেনি। কোনো ধরনের টাকা পাইনি এখান থেকে।


এমন আরেক কৃষক চন্দনবাইশা ইউনিয়নের ঘুঘুমারি গ্রামের মো. ওবাইদুল। তিনি নিজের খরচে কলা চাষ করেছেন। কিন্তু প্রকল্পের তালিকায় তার নাম রয়েছে।


তার দাবি, গত বছর কলা চাষ করেছিলাম স্থানীয় জাতের কলার চারা নিয়ে, সেই গাছেই এখন কলা ধরেনি। আমার মতে অফিস থেকে চারা দেওয়াই ভালো। তাহলে ভালো জাতের চারা পেতাম। গতবার তাও হালিম স্যার থাকতে সার পাছিলাম। এবারতো কোনো কিছুই পাইনি। তাও কলার চাষ করছি, কারণ কৃষি অফিসের রেজাউল ভাই বলছে কলা চাষ করো দিমুনি সব।


এসব কথা বলার পর ওবাইদুল অনুরোধ করে বলেন, এগলে আপনি লিখেন না। তাহলে আর কিছুই পামু না অফিস থেকে। বুঝেনিতো সব।
এ বিষয়ে জানতে গেলে উপ-সহকারী কৃষি অফিসার রেজাউল করিম জানান, কৃষক ওবাইদুলের জমির পরিমান কম থাকায় এ প্রকল্পে তাকে নেওয়া হয়নি। তার নাম নাম্বার থাকলেও অন্য কৃষককে দিয়ে কলা প্রকল্পটি করা হচ্ছে তাকে সকল সার দেওয়া হয়েছে।


প্রকল্পে অনিয়মের বিষয়টি অস্বীকার করছেন সারিয়াকান্দি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ।


তিনি বলেন, মিশ্র ফল ও সবজী বাগান প্রকল্পের ১৪ টি প্রদর্শনী পেয়েছি সবগুলো বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করতেছি। কৃষি অফিস থেকে জৈব সার, রাসায়নিক সার, নেট, ঔষধ দেওয়া হয়েছে। চারা কিনে নিতে বলা হয়েছে। পরে তাদের টাকা দেওয়া হবে। সকল প্রকল্প বাস্তবায়ন করে খরচের হিসাব জমা দিয়ে টাকা তুলতে হয় বলে জানান তিনি।
কিন্তু প্রকল্পের বরাদ্দ ও ব্যয়ের হিসাব জানতে চাইলে এটি গোপনীয় তথ্য বলে মন্তব্য করেন এই কৃষি কর্মকর্তা।

এই বিভাগের অন্য খবর

Back to top button