বগুড়া জেলা
ট্রেন্ডিং

করতোয়া নদীর ১৬.৯৭ একর জায়গা দখল করেছে টিএমএসএস: ডিসি


বগুড়া সদর উপজেলায় করতোয়া নদীর প্রায় ১৭ একর জমি দখল করেছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘ (টিএমএসএস)।

বুধবার সকাল থেকে এসব জমি উদ্ধারে অভিযানে নামে বগুড়ার জেলা প্রশাসনের সমন্বয়ে একটি টিম। দিনভর অভিযান চালিয়ে প্রায় ২ একর জমি উদ্ধার করা হয়েছে বলে অভিযান থাকা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

ওই দিন সদরের বাঘোপাড়ায় টিএমএসএসের বিসিএল গ্লাস ফ্যাক্টরিতে (নির্মাণাধীন) জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার ও এক্সেকিউটিভে ম্যাজিস্টেট নাহিয়ান মুন্সিফ এই উদচ্ছেদ অভিযান শুরু করেন।

এ সময় পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী কর্মকর্তা নাজমুল হক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের বগুড়া জেলা কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ ফজলে রাব্বী ডলারসহ আরও অনেকে ছিলেন। অভিযানে সহায়তা করেন পুলিশ, সেনাবাহিনী, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা এবং ফায়ার সার্ভিসের একাধিক দল।

গত বছরের মার্চ মাসে বগুড়া জেলা প্রশাসন এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড করতোয়া নদীর পুনঃখননের সময় নদীর সীমানা নির্ধারণের জন্য ১৪ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে।

কমিটি সেই রিপোর্টে বলা হয়েছে, টিএমএসএস গ্লাস ফ্যাক্টরি সংলগ্ন এলাকায় করতোয়া নদীর খাস জমিতে ১১ টি অবৈধ্য স্থাপনা নির্মাণ করেছে। এর মাধ্যমে নদীর ৯৩ দশমিক ১৫ শতক জমি দখল করেছে। আজকের অভিযান এই দখল করা জমি উদ্ধার থেকেই শুরু হয় বলে জানিয়েছেন বগুড়া জেলা কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ ফজলে রাব্বী ডলার।

তিনি বলেন, আজ বাঘোপাড়া-গোকুল-মহিষবাথান এলাকায় করতোয়া নদীর জায়গায় অবৈধভাবে গড়ে তেলা টিএমএসএসের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান বিসিএল কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের মালিকানাধীন গ্লাস ফ্যাক্টরির প্রথম শেডের ৭০ শতাংশ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। নদীর জমিতে আরও অবৈধ স্থাপনা সরিয়ে নিতে টিএমএসএসকে দুই দিনের সময় দিয়েছে প্রশাসন।

অবৈধ্য দখলের বিষয়ে টিএমএসএস উপ-নির্বাহী পরিচালক এবং বিসিএল গ্রূপের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক সারোয়ার মোহাম্মদ সাংবাদিকদের বলেন, ” এখন পর্যন্ত এই স্থাপনা অবৈধ নয়। যে জমিতে আমরা বিসিএল গ্লাস ফ্যাক্টরি নির্মাণ করা হয়েছে, তা নদীর অংশ নয়। নদীর পাশের জায়গা।’

এই জমির মালিক কে জানতে চাইলে সারোয়ার মোহাম্মদ বলেন, ” জমির মালিক সরকার। এখানে আমাদের ৩৮ একর জমি আছে। আরও স্থাপনা করা হয়েছে সরকারি জমি লিজ নিয়ে। এগুলোর পক্ষে কাগজপত্র জেলা প্রশাসনকে দেওয়া হয়েছে।’

বগুড়ার জেলা প্রশাসক হোসনা আফরোজা বলেন, ” আমরা টিএমএসএসকে তাদেরকে অবৈধ স্থাপনা সরানোর জন্য গত ফেব্রুয়ারি মাসে নোটিস দিয়েছিলাম। কিন্তু তারা স্থাপনা না সরিয়ে আদালতে গিয়ে এক পাক্ষিকভাবে নিষেধাজ্ঞা (ইনজাংশন) জারি করে নিয়ে আসে। আমরা কোর্টের জবাব দিয়েছি। পরে আদালত ইনজাংশন ভ্যাকেড করেছে। তাদের আবেদনটা খারিজ হয়েছে। এর পরে তারা উচ্চ আদালতে একটা আপিল করেছে। কিন্তু সেখানে কোন ইনজাংশন নেই| এর আগে তারা জজ কোর্টে একটা মামলা করেছিল। কিন্তু এটা যেহেতু নদীর জমি সুতরাং নদীর জমি কেউ লিজ দিতে পারে না। আমরা সেই মামলায় হাইকোর্টে একটি আপিল করি এবং সেখানেও কোন ইনজাংশন নেই।”

“এর আগে মহামান্য হাইকোর্ট তুরাগ নদী নিয়ে একটি রায় দিয়েছিলেন সেখানে বলা হয়েছে নদীর জমি কেউ বন্দবস্ত দিলে শুরুতেই এটি নাল এবং ভয়েড হয়ে যাবে। এবং তুরাগ নদীর এই জাজমেন্টটা বাংলাদেশের যেকোন নদীর জন্য প্রযোজ্য হবে। যেহেতু আদালতের কোন নিষেধাজ্ঞা নেই সেই জন্য আমরা আজ উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করছি এখানে,” বলেন জেলা প্রশাসক।

“টিএমএসএস বিভিন্ন সময়ে নদীর এই ১৬ দশমিক ৯৭ একর জমি লিজ নিয়েছে বলে সবাইকে বিভ্রান্ত করে । লীজের যে কাগজপত্র টিএমএসএস আমাদের কাছে জমা দিয়েছে সেগুলো আমরা পর্যালোচনা করে দেখেছি যে সরকারি জমি বন্দোবস্ত দেওয়ার জন্য বা লিজ দেওয়ার জন্য যে শর্তগুলো থাকার কথা সেই চিঠির ভাষা এবং বন্দোবস্ত কেস কিছুই নেই। এই চিঠিগুলো আমার কাছে মনে হয়েছে ফেব্রিকেটেড (অতিরঞ্জিত)। এর পর আমরা পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে নদীর সীমানা নির্ধারণের কাজ করি।

“সীমানা নির্ধারণে দেখা গেছে টিএমএসএস বিভিন্ন সময় নদীর যে স্বাভাবিক পানির প্রবাহের দুইটি লুপে পর্যায়ক্রমে মাটি দিয়ে ভরাট করে ১৬ দশমিক ৯৭ একর নদীর জমি দখল করে বিভিন্ন স্থাপনা নির্ধারণ করেছে। একটি জায়গায় (মিহিসাবান মৌজায় মেডিকেল স্টুডেন্টদের জন্য ছাত্রাবাস, একটি অক্সিজেন প্লান্ট, একটি শহীদ মিনার এবং নির্মাণ করছে। আর একটি অংশে এই বিসিএল গ্লাস ফ্যাক্টরি নির্মাণ করেছে”, বলেন জেলা প্রশাসক।

এর আগে ২০১৮ সালে বগুড়া জেলা প্রশাসনে করতোয়া নদীর ৩৮ টি দখলদারের একটি তালিকা তৈরী করে। এই জরিপ রিপোর্টে দেখা যায় বগুড়া সদর উপজেলার মহিষাবান মৌজায় টিএমএসএস একাই ৪ দশমিক ৯ একর নদীর জমি দখল করে বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করে। পরে বিভিন্ন সময় উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করা হলেও এখনো সেই জমি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

এরপর জাতীয় নদী কমিশন ২০১৯ সালে বগুড়ার করতোয়া, যমুনা ও বাঙ্গালী নদী সরেজমিন পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন শেষে করতোয়া দখল দূষণের জন্য দায়ী করে টিএমএসএস ও বিসিএলের বিরুদ্ধে ওই বছরই একটি প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।

তালিকাভুক্ত দখলকারীদের অনেককে উচ্ছেদ করা হলেও দুই দখলদার টিএমএসএস ও বিসিএল থেকে যায় বহাল তবিয়তে। এই দুই দখলদারই শেষ পেরেকটা হানে করতোয়ার বুকে।

বিষয়টি জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ড বগুড়ার নির্বাহী প্রকৌশলী নাজমুল হক বলেন, ” আগে গ্লাস ফ্যাকটির এই ৯৩ দশমিক ১৫ শতক জমি উদ্ধার করব। এর পরে মহিষাবান মৌজার ৪.৯ একর জমি দখলমুক্ত করা হবে।’

এর আগে ২০২৩ সালে বগুড়া সদর উপজেলার মোমো-ইন-ইকো পার্ক (টিএমএসএস-এর মালিকানাধীন) সংলগ্ন করতোয়া নদীর উপর অবৈধভাবে একটি মাটির রাস্তা নির্মাণের চেষ্টার জন্য একটি ভ্রাম্যমাণ আদালত টিএমএসএসকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করে।

একই বছরের মে মাসে বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ড একটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার নির্দেশনা অনুসরণ করে করতোয়া নদী দখলের অভিযোগে টিএমএসএসের বিরুদ্ধে বগুড়া সদর থানায় একটি মামলা করেন। এটি চলমান।

এই বিভাগের অন্য খবর

Back to top button