
নিজস্ব প্রতিবেদক: বগুড়ার প্রান্তিক মানুষদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে তিনটি ২০ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এরপর কেটে গেছে প্রায় দুই দশক। উদ্বোধন করেও হাসপাতাল তিনটিতে আজও স্বাস্থ্যসেবা চালু হয়নি। এই হাসপাতাল তিনটি বগুড়ার নন্দীগ্রাম, শিবগঞ্জ ও আদমদীঘি উপজেলায় অবস্থিত।
স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, নামমাত্র জনবল দিয়ে হাসপাতাল তিনটিতে শুধু বহির্বিভাগ চালু করা গেছে। তবে তা দিয়ে ওষুধ বিতরণ ছাড়া আর কোনো সেবাই দেয়া সম্ভব নয়।
স্থানীয়দের আক্ষেপ, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে ২০ বছরেও হাসপাতাল তিনটি চালু করা হয়নি। গেল দুই দশকে হাসপাতাল চলার মতো জনবল নিয়োগ না দেওয়া হয়নি। এতে হাসপাতালেই নষ্ট হয়েছে লক্ষ লক্ষ টাকার যন্ত্রপাতি।
জেলার স্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নন্দীগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেটি উপজেলা সদর থেকে ৯ কিলোমিটার দূরের ভাটগ্রাম ইউনিয়নের বিজরুল বাজারে অবস্থিত। উপজেলা সদরে কোনো স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স না থাকায় পৌর শহরসহ আশেপাশের মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছিল। বিষয়টি আমলে নিয়ে ২০০২ সালে উপজেলার পৌর এলাকায় একটি আধুনিক মানের হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। উদ্বোধন করা হয় ২০০৬ সালে। নির্মাণে মোট ব্যয় হয় ৩ কোটি ২৬ লাখ ৭৩ হাজার ১৬৮ টাকা। নন্দীগ্রাম হাসপাতালের জন্য ২০০৮ সালে ১৮টি পদ সৃষ্টি হয়। কিন্তু পদায়ন আর হয়নি।
দীর্ঘ সময় অবহেলায় থেকে হাসপাতালের চারটি ভবনের বিভিন্ন জায়গায় ফাটল ধরেছে। জানালা, দরজা নষ্ট প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে। কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী এখানে পদায়ন করা হলেও তাদের অনেককে প্রেষণে বিভিন্ন হাসপাতালে রাখা হয়েছে।
নন্দীগ্রাম পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মাঝগ্রাম এলাকার বাসিন্দা আরিফুল ইসলাম জানান, আমাদের জন্য উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়া কষ্টকর। বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেলে যাওয়াও কষ্টকর। আর বাড়ির কাছে যে হাসপাতাল আছে, তা শুধু ভবন। বিগত সরকারের সময় রাজনীতির মারপ্যাঁচে পড়ে হাসপাতাল ভুতের বাড়িতে পরিণত হয়েছে।
এই হাসপাতালের দায়িত্বে থাকা আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) আতিক আহমেদ জানান, আমিসহ কয়েকজনকে এখানে পদায়ন করা হয়েছে। হাসপাতালটির অবস্থা খুবই খারাপ। এখানে শুধু অবকাঠামো আছে। কিন্তু অবকাঠামোকে ব্যবজার করতে প্রয়োজন জনবল। রোগ নির্ণয় ও অপারেশনের জন্য যন্ত্রপাতি লাগবে। একই সাথে সেগুলো চালু করতে লাগবে জনবল ।
ডা. আতিক বলেন, এখন শুধু বহির্বিভাগ চলছে। কিন্তু দায়িত্বরত কর্মচারীদের বেতন অনিয়মিত। অনেকের প্রায় ৬ মাসের মত বেতন পাওনা আছে। এসব কারণে এই হাসপাতালে কেউ থাকতে চায় না।
একই রকম অবস্থা শিবগঞ্জ উপজেলার আলীয়ারহাট ২০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের। এটির নির্মাণ ব্যয় হয় ৪ কোটি ৩২ লাখ টাকা। আলীয়ারহাট হাসপাতালের অবস্থান উপজেলা থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে। আর বগুড়া শহর থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার দূরে হবে।
২০০৬ সালে উদ্বোধনের পর থেকেই এই হাসপাতালটিও অবকাঠামো নিয়েই পড়ে আছে। পরবর্তীতে সেখানে বহির্বিভাগ চালু করা হয়। এজন্য একজন উপ-সহকারী মেডিকেল অফিসার দেয়া হয়েছে।
এ ছাড়া এই হাসপাতালে একজন আবাসিক মেডিকেল অফিসার, ৩ জন মেডিকেল অফিসার, ৫ জন স্টাফ নার্স, ১ জন ল্যাব অ্যাসিসটেন্ট ও একজন ওয়ার্ডবয় নিয়োগপ্রাপ্ত রয়েছেন। তারা প্রেষণে অন্য স্থানে কর্মরত।
তবে শনিবার (৫ জুলাই) এই হাসপাতালটি পরিদর্শনে সচিবসহ বিভিন্ন কর্মকর্তাদের আসার কথা। বিষয়টি জানিয়ে শিবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা এ এস এম রুহুল আমিন বলেন, আলিয়ারহাট হাসপাতালটি চালু করার জন্য কিছু পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। সচিব মহোদয় আসার পর পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত নিবেন।
আদমদীঘি উপজেলা থেকে দূরে কিন্তু অর্থনৈতিক ও নানা কারণে সান্তাহার জনগুরুত্বপূর্ণ এলাকা। এখানকার পৌর ও ইউনিয়ন পর্যায়ে মানুষদের সেবার জন্য প্রায় একই সময়ে সান্তাহার পৌরসভার রথবাড়ী এলাকায় ২০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল নির্মাণ কাজ শুরু হয়।
এই হাসপাতালের প্রাথমিকভাবে নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় ৩ কোটি ৩৩ লাখ ৪২ হাজার ৪৮৮ টাকা। নির্মাণ কাজ পায় ঢাকার কোম্পানি কিট-ওয়ে প্যাক। কিন্তু নির্মাণকাজ শেষ না করেই ঠিকাদার বিল তুলে কাজ বন্ধ করে দেন। পরবর্তীতে ২০১৯ সালে একই মন্ত্রণালয় পুনরায় ৩ কোটি ১৩ লাখ ৭৯ হাজার টাকায় হাসপাতালের স্টাফ কোয়ার্টারসহ অবশিষ্ট অবকাঠামো নির্মাণকাজ শুরু হয়। শেষ হয় ২০২১ সালে।
এরপর অন্য দুই হাসপাতালের মতো এটিও পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে। সান্তাহার বাজার এলাকার বাসিন্দা আব্দুল মজিদ আফসোস করে বলেন, এই হাসপাতাল নির্মাণ করতেই লাগলো ১৯ বছরের বেশি। তাও চালু হলো না। হাসপাতাল তো ছিল মাদকসেবনসহ নানা অপরাধের আখড়া। লোকজন না থাকায় বিভিন্ন এর অনেক প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও চুরি হয়েছে।
এখন এখানে একজন ফার্মাসিস্টসহ দুজন বহির্বিভাগের দায়িত্ব পালন করেন বলে জানান আদমদীঘি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ফজলে রাব্বি।
তিনি বলেন, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত শুধু ওষুধ বিতরণ, টিকাদান কর্মসূচী, যক্ষা রোগের ওষুধ বিতরণ কার্যক্রম চলে। সরকারি ছুটির দিনে বন্ধ থাকে। এতটুকুই কার্যক্রম চলমান এই হাসপাতালে।