গাবতলী উপজেলা
ট্রেন্ডিং

ভূমি অফিস স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত বাতিল চান দুই ইউনিয়নের ৩৪ গ্রামের মানুষ

নিজস্ব প্রতিবেদক: বগুড়ার গাবতলী উপজেলার নেপালতলী ইউনিয়নে আশির দশকে চালু হওয়া তহসিল অফিস (বর্তমানে ভূমি অফিস) স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত বাতিল চেয়েছেন দুই ইউনিয়নের ৩৪ গ্রামের বাসিন্দা। এই সিদ্ধান্ত বাতিল চেয়ে কয়েক মাস আগে অর্ধসহস্রাধিক স্বাক্ষরসহ একটি আবেদনপত্র জেলা প্রশাসকসহ ভূমি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন দপ্তরে পাঠানো হয়।


স্থানীয়রা বলছেন, ভূমি অফিস স্থানান্তরে সরকারের যেমন অর্থ অপচয় হবে, তেমনি দুই ইউনিয়ন মিলে প্রায় অর্ধলাখ বাসিন্দা চরম ভোগান্তিতে পড়বেন। কিন্তু এখন অবধি দাবি পূরণ না হওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন ইউনিয়নবাসী। এ বিষয় নিয়ে রোববার দুপুরে বগুড়া শহরে মানববন্ধন করেছে গ্রামবাসী।


ভূমি সেবাগ্রহীতাদের অভিযোগ, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম বাবু (আওয়ামী লীগ নেতা) তাদের মতামত না নিয়েই বছর দেড়েক আগে ইউনিয়নের এক কোণায় ভূমি অফিস স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেন। নিজ বাড়ির কাছাকাছি নেপালতলী ইউনিয়ন কমপ্লেক্সের পাশে ভবন নির্মাণ স্থান চূড়ান্তও করেন। তবে সম্প্রতি ঘটনা জানাজানি হলে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন পুনর্গঠিত নেপালতলী ও নবগঠিত ইউনিয়ন সুখানপুকুর মিলে ৩৪ গ্রামের মানুষ।


চলতি বছরের ২১ এপ্রিলে বগুড়ার জেলা প্রশাসক বরাবর দেওয়া লিখিত আবেদনে বলা হয়েছে, নেপালতলী ইউনিয়নের নেপালতলী স্থানটি মানচিত্রের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের শেষ প্রান্তে অবস্থিত। যেখান থেকে পাশের ইউনিয়ন শুরু হয়েছে। নেপালতলী থেকে ইউনিয়নের অপর প্রান্ত পুটিয়ারঘোনের দূরত্ব প্রায় ১০ কিলোমিটার। অথচ কদমতলী বাজার থেকে এই দূরত্ব অর্ধেক, মাত্র ৪-৫ কিলোমিটার। নেপালতলীর পাশে শাহবাজপুরসহ পাঁচটি গ্রাম থেকেও বর্তমান ভূমি অফিসের দূরত্ব ৪-৫ কিলোমিটারের মতো।


ভূমি অফিস স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত বাতিলের পক্ষে করা আবেদনে ভুক্তভোগীরা ৬টি কারণ উল্লেখ করেছেন। তাদের দাবি, ভূমি অফিসের নতুন অবস্থান পুনর্গঠিত নেপালতলী ইউনিয়নের ১৫ মৌজার ২৭ গ্রামের মধ্যে ১৬টি গ্রাম থেকেই বেশি দূরে। সহজ যাতায়াতের জন্য পর্যাপ্ত যানবাহন নেই। বিশেষ করে বয়স্ক, নারী, প্রতিবন্ধী ও অসুস্থ সেবাপ্রার্থীদের জন্য অত্যন্ত কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে। তাছাড়া দূরত্বের কারণে ভূমি সংক্রান্ত জরুরি সেবা (মৃত্যুজনিত নামজারি, জমির জরিপ, বিক্রয়) পেতে বিলম্বও হবে। এতে অনেকে সেবাগ্রহণে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়বেন। কর্ম বা পেশাজীবীরাও পড়বেন বিপাকে।


শুধু তাই নয়, ২০১৯ সালে গঠিত সুখানপুকুর ইউনিয়নের ৩৫টি গ্রামের মধ্যে ১৮টির সেবাগ্রহীতারাই কদমতলী ভূমি অফিস থেকে সেবা গ্রহণ করে থাকেন। এ ব্যাপারে ধলিরচরের সাবেক সেনাসদস্য আনিছুর রহমান, বীর মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষক হাফিজারসহ একাধিক বাসিন্দা জানান, নেপালতলী ইউনিয়ন ভেঙে যে সুখানপুকুর ইউনিয়ন করা হয়েছে সেখানকার অর্ধেকের বেশি মানুষ বর্তমান ভূমি অফিস থেকে সহজে সেবা নিচ্ছেন। স্থানান্তর করা হলে তারা চরম ভোগান্তিতে পড়বেন।
একই দাবি জানিয়ে সুখানপুকুর ইউনিয়নের ময়নাতলার অবসরপ্রাপ্ত প্রভাষক মোহাম্মদ ফজলে রাব্বি, বলেন, সেবাগ্রহীতাদের মতামত না নিয়েই সাবেক চেয়ারম্যান ক্ষমতার জোরে তার বাড়ির পাশে ভূমি অফিস নিয়ে গেছেন। এই সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই মানব না।


চকরাধিকা গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য তোফাজ্জল হোসেন বলেন, কদমতলী নেপালতলী ও সুখানপুকুর ইউনিয়নের মধ্যবর্তী স্থান। এখানে ভূমি অফিস থাকলে দুই ইউনিয়নের ৩৪ গ্রামের মানুষ সুবিধা পাবে। আর নতুন স্থানে নিলে সর্বোচ্চ ১১ গ্রামের মানুষের উপকার হবে।
ভূমি অফিসের ভবন নির্মাণ কার্যক্রম মাঝপথে থেমে গেছে জানিয়ে নেপালতলী ইউপির বর্তমান চেয়ারম্যান সঞ্জয় মজুমদার বলেন, নির্ধারিত স্থান ইউনিয়নের এক প্রান্তে হলেও ইউনিয়নের সবাইকে তো জেলা ও উপজেলায় যেতেই হয়। জেলা সড়কের পাশে হওয়ায় নেপালতলী সবার জন্যই সুবিধাজনক।


স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে জানা যায়, স্বাধীনতার পর প্রতিষ্ঠিত নেপালতলী ইউনিয়নের ভূমি সেবা কার্যক্রম চলত পাশের আরেকটি ইউনিয়নে অবস্থিত ভবনে। ১৯৮৪-৮৫ সালের দিকে তৎকালীন চেয়ারম্যান ইউনিয়নের মানচিত্রের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত কদমতলী গ্রামে খাস জায়গায় তহসিল অফিস স্থাপন করেন। এরপর কয়েক দশক ধরে জরাজীর্ণ ভবন থেকে ভূমি সেবা পরিচালিত হচ্ছিল। এর মধ্যে ২০১৬ সালে সরকার ভূমি সেবার আধুনিকায়নে সারা দেশে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে ভূমি অফিস নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নেয়।
প্রথম দফায় ১ হাজার ভূমি অফিস নির্মাণ শেষে দ্বিতীয় পর্যায়ে আরও ১৩৩৩টি শহর ও ইউনিয়ন ভূমি অফিস নির্মাণ প্রকল্প ২০২৩ সালে একনেক সভায় অনুমোদন পায়। এর অধীনে কদমতলী ইউনিয়ন ভূমি অফিস নির্মাণ কার্যক্রম শুরু হয়। ২০২৪ সালে ইউপি চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম বাবু কদমতলীর বদলে নেপালতলীতে ভূমি অফিস নির্মাণে ইউপি কমপ্লেক্সের পাশেই স্থান নির্ধারণ করে দেন। মাটি পরীক্ষা শেষে স্থান চূড়ান্ত করে ভবন নির্মাণে কার্যাদেশসহ ঠিকাদারও নিযুক্ত করা হয়।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর গাবতলী উপজেলা প্রকৌশলী সাজেদুর রহমান বলেন, কদমতলীতে জায়গা নিয়ে জটিলতা দেখা দেওয়ায় ২০২২ সালে নেপালতলীতে ভবন নির্মাণের আবেদন করা হয়। ২০২৪ সালে মাটি পরীক্ষা শেষে কার্যাদেশ দেওয়ার পর গত জুন মাসে ঠিকাদারও নিযুক্ত হয়। তবে এক আবেদনের প্রেক্ষিতে কার্যক্রম স্থগিত হয়ে গেছে।


গাবতলীর সহকারী কমিশনার (ভূমি) এম. আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ আহমেদ বলেন, ভূমি অফিস স্থানান্তরে এলাকাবাসীর প্রতিবাদের প্রেক্ষিতে নতুন নির্মাণ কার্যক্রম স্থগিত হয়ে গেছে। যে অবস্থানে থাকলে বেশিরভাগ মানুষ সহজে সেবা পাবেন, কার্যক্রম সেখান থেকেই পরিচালিত হওয়া প্রয়োজন।


তবে জনসাধারণের সুবিধার জন্য ভূমি অফিস কদমতলীতে রাখার জোর দাবি জানিয়েছেন জাতহলিদা গ্রামের বাসিন্দা, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ড. মো. ইকতিয়ার উদ্দিন। তিনি বলেন, ইউনিয়নের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত কদমতলীর ভূমি অফিসটি যেখানে স্থানান্তরিত করার পাঁয়তারা করা হচ্ছে সেটা এক কোণায় অবস্থিত। এতে ভূমিসেবা ভেঙে পড়বে।


একই রকম যুক্তি দেখালেন কদমতলী গ্রামের বাসিন্দা বগুড়ার সরকারি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের কম্পিউটার ইন-চার্জ সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার মোস্তফা আহসান হাবীব রিমন। তিনি বলেন, ভৌগোলিক দিক থেকে ইউনিয়নের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থানে কদমতলী। অন্যতম প্রধান চারটি পাকা সড়কের সংযোগস্থল। তাছাড়া এলাকাটি অর্থনীতির হাব হিসেবে কাজ করছে। ভূমি অফিস এখান থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার নীল নকশার তীব্র প্রতিবাদ জানাই।

গাবতলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মাদ হাফিজুর রহমান বলেন, ইউনিয়নের একাংশ চাচ্ছেন কদমতলীতে ভূমি অফিসটি রাখতে। আরেকটি অংশ চাচ্ছেন নতুন স্থানে। আমরা দুপক্ষের সাথে কথা বলছি। আলোচনার মাধ্যমে চেষ্টা করছি বিষয়টি সমাধান করতে।

এই বিভাগের অন্য খবর

Back to top button