
মাসুম হোসেন: রাত পৌনে বারোটা। নিঃস্তব্ধ শহরের কোণে এক চায়ের দোকানে বসে আছেন লালু। সড়কের দিকে তার নির্বাক দৃষ্টি। পকেটে তার সামান্য কিছু টাকা। দিনের শেষে চায়ের কাপে যেন লালুর হতাশার চুমুক।
ঘণ্টা পাঁচেক টানা বৃষ্টি। রিকশা নিয়ে বের হতেই পারেননি লালু। বৃষ্টি থেমে গেলে বিকেলের একটু আগে বের হন। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় পানিবন্দি সড়ক। জলাবদ্ধতার সঙ্গে যুদ্ধ করে দিনের শেষে হাতে আসে তার কিছু টাকা। তার সেই আয়ে পাঁচ সদস্যের পরিবারে এক বেলা খাবার জুটানোই মুশকিল। চায়ের চুমুকে ভাবছেন লালু, কেমন কাটবে আগামীকাল?
প্রশ্নটা শুধু লালুর একার নয়; শহরের রিকশা-ভ্যানচালকসহ খেটে খাওয়া অনেক মানুষেরও। তবে দুর্ভোগে যে শুধু তারাই পড়েছেন তা কিন্তু নয়। কর্মজীবী নারী-পুরুষ থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীরাও পানিবন্দি সড়কের শিকার হয়েছেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রিকশার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থেকে শেষমেশ পানিতে হেঁটে কেউ পৌঁছেছেন গন্তব্যে, কেউ ফিরেছেন ঘরে।
গল্পটা বগুড়া শহরের গোহাইল সড়কের। আশপাশের অনেক রাস্তায় পানি জমলেও এই সড়কের গুরুত্বটা বেশি। শহরের দক্ষিণ অংশের প্রধান তিনটি সড়কের একটি হলো গোহাইল সড়ক। অথচ সামান্য বৃষ্টিতেই এই সড়কটিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। সেইসাথে সড়কটি খানাখন্দে ভরা।
রিকশাচালক ৫৫ বছর বয়সী লালু মিয়ার সঙ্গে বগুড়া শহরের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের ফুলতলা এলাকার এক চায়ের দোকানে কথা হয়। সেই দোকানের পাশেই এক রিকশা গ্যারেজ রয়েছে। সেখানকার একজনের রিকশা ভাড়ায় চালান লালু। তিনি শহরের চকফরিদ এলাকার বাসিন্দা।
মঙ্গলবার (১৫ জুলাই) সকাল সাড়ে আটটা থেকে বগুড়ার শহরের ব্যাপক বৃষ্টিপাত হয়। বৃষ্টিতে সড়কে পানি জমে যাওয়ায় দুর্ভোগে পড়েন তিনি।
বৃষ্টি প্রাকৃতিক বিষয়, গোহাইল সড়কে (ফুলতলা-সাতমাথা) জনভোগান্তির দায় তার নয়। সড়কের ধারে ড্রেনেজ ব্যবস্থা অকেজো হয়ে পড়েছে। বৃষ্টি ও নর্দমার পানি মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে সড়ক। যা হঠাৎ সৃষ্টি হওয়া কোনো দৃশ্য নয়, দুই যুগ ধরে গোহাইল সড়কের একই চিত্র বলছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এরপরেও হয়নি প্রয়োজনীয় সংস্কার, কমেনি ভোগান্তি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পানিবন্দি হয়ে থাকে সড়ক।
লালু বলেন, ‘রাস্তায় বৃষ্টির পানি জমে থাকায় রিকশা চালাতে পারিনি। বিকেলের দিকে একটু পানি কমলে কিছু ভাড়া পাই। যে কয় টাকা আয় হছে, তা দিয়ে পরিবার নিয়ে একবেলা ভাতও খাওয়া কঠিন। মহাজনের ও গ্যারেজ ভাড়া দিয়ে অল্প টাকা থাকবে। কাল (১৬ জুলাই) যদি একই দিন যায়, খুব বিপদে পড়তে হবে।’
তিনি আরও জানান, মঙ্গলবার তার ৪০০ টার মত আয় হয়। এরমধ্যে মহাজন ও গ্যারেজ ভাড়া ২৮০ টাকা। তার কাছে থাকে ১২০ টাকা।
জানতে চাইলে বগুড়া পৌরসভার প্রশাসক ও স্থানীয় সরকারের উপপরিচালক মাসুম আলী বেগ বলেন, ‘শহরের বিভিন্ন স্থানে ড্রেনেজ ব্যবস্থায় যেখানে পানি আটকে থাকে, সেগুলো চিহ্নিত করে কাজ চলছে। শহরের বাদুরতলা এলাকায় একটি মাস্টার ড্রেন (বড় ড্রেন) নির্মাণের কাজ চলছে, যার মুখ আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। কাজটি সম্পন্ন হলে শহরের জলাবদ্ধতার সমস্যা অনেকটা কমে যাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সাময়িক সমাধানের পাশাপাশি ভবিষ্যতে জলাবদ্ধতা নিরসনে স্থায়ী ও টেকসই পরিকল্পনার আওতায় কাজ করা হবে।’
তবে দীর্ঘ সময় ধরে লালুদের এমন ভোগান্তিই বলে দিচ্ছে, শহরের সড়ক ব্যবস্থাপনায় তাদের কথা ভাববার মত যেন কেউ নেই।