আগুনে দগ্ধ না হয়েও মৃত্যু, কত শতাংশ পুড়লে প্রাণহানির আশঙ্কা তৈরি হয়?

আগুনে দগ্ধ রোগীর চিকিৎসায় শরীরের কত শতাংশ পুড়েছে, সেটি বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ। তবে অনেক সময় শরীরের কম অংশ দগ্ধ হলেও বা বাহ্যিকভাবে দগ্ধ না হলেও মৃত্যু হতে পারে। কারণ, আগুনের পাশাপাশি ধোঁয়ার বিষক্রিয়া বা শ্বাসনালী দগ্ধ হওয়ার মতো অদৃশ্য ঝুঁকিও মারাত্মক হতে পারে।
দগ্ধতার শতাংশ নির্ধারণ
শরীরের কতটা অংশ পুড়েছে, তা দ্রুত নির্ণয় করে চিকিৎসা শুরু করাই রোগীর জীবন বাঁচানোর প্রথম ধাপ। এজন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কয়েকটি পদ্ধতি রয়েছে।
দিনাজপুর মেডিকেল কলেজের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের প্রধান ডা. শরমিন আক্তার সুমি জানান, সবচেয়ে প্রচলিত পদ্ধতি হলো ‘Rule of Nine’। এই পদ্ধতিতে শরীরের বিভিন্ন অংশকে ৯ শতাংশ বা তার গুণিতকে ভাগ করে দগ্ধতার শতকরা হিসাব নির্ণয় করা হয়। যেমন, একটি হাত ৯%, পায়ের সামনের ও পেছনের অংশ ৯% করে ধরা হয়।
আরও নির্ভুল ফলাফলের জন্য ব্যবহৃত হয় ‘Lund and Browder Chart’। এটি বয়সভেদে শরীরের গঠনের পার্থক্য বিবেচনায় নেয়। শিশুর ক্ষেত্রে মাথার অংশ বড় হওয়ায় দগ্ধতার শতাংশও বেশি ধরা হয়।
শরমিন জানান, এছাড়া ‘Rule of Thumb’ নামেও একটি পদ্ধতি রয়েছে, যেখানে রোগীর হাতের তালুকে ১% ধরে ছোট ছোট অনিয়মিত পোড়ার জায়গাগুলোর হিসাব করা হয়। তবে বিশ্বজুড়ে প্রধানত ‘Rule of Nine’ ও ‘Lund and Browder Chart’ ব্যবহৃত হয়।
কত শতাংশ দগ্ধ হলে বিপদ?
ডা. সুমির ভাষ্য অনুযায়ী, সাধারণত ১৫% পর্যন্ত দগ্ধতা নিরাময়যোগ্য। ১৫% থেকে ৩০% দগ্ধ হলে নিবিড় পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন পড়ে। আর ৩০%–৫০% দগ্ধ রোগীদের চিকিৎসায় বিশেষ মনোযোগ লাগে। তবে ৫০% ছাড়িয়ে গেলে তা ‘ক্রিটিক্যাল’ হিসেবে বিবেচিত হয়। ৭০–৭৫% দগ্ধতা পার করলে রোগীকে বাঁচানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
তবে তিনি জানান, বয়স, পূর্ববর্তী অসুস্থতা ও রোগীর সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনায় এই হার পরিবর্তিত হতে পারে। যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক, গর্ভাবস্থা বা কোমরবিড কন্ডিশনে থাকা রোগীদের ক্ষেত্রে কম পরিমাণ দগ্ধ হলেও ঝুঁকি বেশি থাকে।
দগ্ধতা কম, তবু মৃত্যু কেন?
শুধু দেহের শতকরা হিসাব যথেষ্ট নয়। অনেক সময় দেখা যায়, রোগীর মাত্র ৫–১০% দগ্ধতা, কিন্তু তার শ্বাসনালী পুড়ে গেছে—যাকে বলা হয় ‘Inhalation Burn’। এটি থেকে ARDS (Acute Respiratory Distress Syndrome) তৈরি হতে পারে, এমনকি নিউমোনিয়ার মাধ্যমে মৃত্যু ঘটতে পারে।
ডা. সুমি জানান, অনেক সময় শরীর না পুড়লেও বিষাক্ত ধোঁয়ার কারণে দম বন্ধ হয়ে রোগী মারা যেতে পারেন। বিশেষ করে ঢাকার বেইলি রোডে গ্রিন কোজি কটেজে অগ্নিকাণ্ডে মৃতদের শরীরে আগুনে পোড়ার লক্ষণ খুব কম ছিল। তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন জানিয়েছিলেন, তারা মূলত কার্বন মনোক্সাইডের শিকার হয়ে মারা যান।
এই ধোঁয়া গলার ভেতরের নরম টিস্যু নষ্ট করে দেয় এবং দেহে প্রবেশ করে বিষক্রিয়া তৈরি করে, যা মৃত্যু পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে।
উপসংহার
দগ্ধতার চিকিৎসা নির্ভর করে রোগীর বয়স, শরীরের অবস্থা, দগ্ধতার পরিমাণ ও ধরনসহ নানা বিষয়ের ওপর। সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু এবং পর্যবেক্ষণই পারে একটি জীবন বাঁচাতে। তাই আগুনে দগ্ধ হলে শুধু পোড়ার পরিমাণ নয়, রোগীর পূর্ণ শারীরিক অবস্থা মূল্যায়ন করাই সবচেয়ে জরুরি।
তথ্যসূত্র: বিবিসি