নৃশংসতায় উল্লাস; আত্মাহীন প্রজন্ম ভবিষ্যতের রূপরেখা?
মাসুম হোসেন: কারও মৃত্যু, কষ্ট বা অপমানে কেউ কেউ উল্লসিত হচ্ছেন। এটা শুধু ভয়ানকই নয়, এক নতুন রকমের নৃশংসতা। অন্যের কষ্টে যারা খুশি হন, তারা সেই ঘটনার চেয়েও আরও বেশি ভয়ঙ্কর। কারণ তাদের অন্তরে মানবতা নয়, দানা বাঁধে নির্মম উল্লাস।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা যায়, কেউ দুর্ভাগ্যের শিকার হলে, কেউ বিপদের মধ্যে পড়লে; অনেকেই হাসির ইমোজি দেয়, কটাক্ষ ও বিদ্রূপ করেন। কারও কষ্ট তাদের কাছে বিনোদনে পরিণত হয়েছে। সহানুভূতি যেন বিলুপ্ত প্রায় একটি গুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে! বিশেষ করে তরুণ সমাজের একটা বড় অংশ মানসিকভাবে দিন দিন এমন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছেন। কারও অমানবিক মৃত্যু, কারও অশ্রুতে যদি কেউ আনন্দ খুঁজে পান, তবে সে আসলে ভিতর থেকে মৃত। যা সমাজে আশঙ্কাজনক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
তরুণরা সমাজের ভবিষ্যৎ। এই ভবিষ্যতের ভিতর থেকে করুণা, সহানুভূতি ও ন্যায় বোধ হারিয়ে গেলে সামনের প্রজন্ম আরও বেশি আত্মকেন্দ্রিক ও সহিংস মানসিকতার হয়ে উঠবে। তখন মানবিক সমাজ গড়ে তোলার স্বপ্ন এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্নে রূপ নেবে।
নৃশংসতা মানসিক বিপর্যয়
নৃশংসতায় আনন্দ-এক মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখা যায়, কেউ কান্নায় ভেঙে পড়েছেন, কেউ প্রাণ হারিয়েছেন, কেউ অপমানের শিকার হয়েছেন। এসব দৃশ্যের নিচে হাজারো মন্তব্য। যার একটি অংশ বিদ্রূপে ভরা থাকে। কেউ লিখছেন, ঠিকই হয়েছে, কেউ বলছে, আরো উচিত ছিল, কেউ কেউ হেসে উঠছেন একগুচ্ছ ইমোজিতে।
যা দেখে ধারণা করা যায়, তরুণদের হৃদয় থেকে মুছে গেছে সহানুভূতি ও সহমর্মিতার চিহ্ন। তাদের ভিতরে স্থান করে নিয়েছে অন্ধ উল্লাস আর কৃত্রিম সাহসিকতা। এটা শুধু অসচেতনতার ফল নয়, মানসিক গঠনে গভীর ক্ষয়ের প্রমাণ। দিন দিন সমাজের নৃশংসতা বিনোদনের বিষয় হয়ে উঠছে। যা শুধু অপরাধই নয়, এক প্রজন্মব্যাপী নৈতিক বিপর্যয়ের পূর্বাভাস।
সমাজে প্রভাব
নৃশংসতায় আনন্দ খুঁজে পাওয়ার প্রবণতা কেবল ব্যক্তি পর্যায়ের সমস্যা নয়, এটি সমাজের ওপরও ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। যখন মানুষ অন্যের কষ্ট দেখে খুশি হন, তখন সামাজিক সংহতি ভেঙে পড়ে। সমাজ হারিয়ে ফেলে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, নিরাপত্তা ও দায়িত্ববোধ। সামাজিকভাবে বৈধতা পায় নৃশংসতা। আর অপরাধীরা পান জনসমর্থন। এমনকি তারা হিরো হয়ে ওঠে কিছু মানুষের চোখে। এভাবে চলতে থাকলে সবচেয়ে ভয়ানক বিষয় হবে, কারও দুঃখ-কষ্ট ও যন্ত্রণা আর কাউকে কাঁদাবে না।
সমাধানের পথ
এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে প্রয়োজন সমবেত মানসিক পরিবর্তন। পরিবারকে ফিরিয়ে আনতে হবে মূল্যবোধের শিক্ষায়। তরুণদের কেবল পুঁথিগত বিদ্যা নয়- মানবিকতা, সহানুভূতি ও সমবেদনার শিক্ষাও দিতে হবে। সেইসাথে সোশ্যাল মিডিয়ায় সহানুভূতির প্রতিফলন ঘটাতে তাদেরকে উৎসাহিত করতে হবে। একটি শিশুকে প্রথম শেখাতে হবে-অন্যের কষ্টে আনন্দ নয় সহানুভূতি দেখানোই মানবতা।
যদিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা সোশ্যাল মিডিয়া সমাজের সামগ্রিক চিত্রকে পুরোপুরি প্রতিফলিত করে না। তবুও একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে তরুণ প্রজন্মের অধিকাংশই প্রতিদিন দীর্ঘ সময় এই মাধ্যমে অতিবাহিত করছেন। ফলে এটি শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, বরং চিন্তা, মূল্যবোধ ও আচরণ গঠনের ক্ষেত্রেও গভীর প্রভাব ফেলে। ভার্চুয়াল জগতে তরুণদের মাঝে মানবিকতা, সহমর্মিতা ও নৈতিক বোধ জাগ্রত করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেন হয়ে ওঠে একটি ইতিবাচক, শিক্ষামূলক ও মানবিক সমাজ গঠনের সহায়ক শক্তি।
সেইসাথে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে- তরুণরা নৃশংসতায় উল্লাস করবেন, নাকি মানুষ হয়ে উঠবেন? এই সিদ্ধান্তই ভবিষ্যতের রূপরেখা ঠিক করবে।