ভুয়া আইটিকর্মী পাঠাচ্ছে উত্তর কোরিয়া, বিদেশি কোম্পানির উপার্জনে বসাচ্ছে ভাগ

পশ্চিমা বিভিন্ন কোম্পানিতে ছদ্মপরিচয়ে শত শত আবেদন করে বহু বছর ধরে অনলাইনে কাজ করতেন জিন-সু (ছদ্মনাম)। বিবিসিকে তিনি জানিয়েছেন, এই কার্যক্রম ছিল উত্তর কোরিয়ার অর্থ সংগ্রহের একটি গোপন পরিকল্পনার অংশ।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের একাধিক প্রতিষ্ঠানে একসঙ্গে কাজ করে মাসে কমপক্ষে পাঁচ হাজার ডলার আয় করতেন তিনি। জিন-সুর মতে, তার কিছু সহকর্মীর আয় ছিল আরও বেশি। তবে এই আয়ের ৮৫ শতাংশই নিয়ে নিত উত্তর কোরিয়ান সরকার।
বহু বছর ধরেই আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞায় বিপর্যস্ত উত্তর কোরিয়া তাদের নাগরিকদের চীন, রাশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে এই কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এই কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করে দেশটির গোপন গোয়েন্দা সংস্থা।
বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জিন-সু জানান, তারা মূলত পশ্চিমা নাম ও পরিচয় ব্যবহার করে আইটি চাকরির জন্য আবেদন করতেন। ইউরোপীয় পরিচয় ব্যবহার করায় সহজেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কোম্পানিতে কাজ পেতেন তারা।
জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই গোপন আইটি কর্মীদের মাধ্যমে উত্তর কোরিয়া প্রতি বছর ২৫ কোটি থেকে ৬০ কোটি ডলার আয় করে। কোভিড মহামারির সময় রিমোট কাজের সুযোগ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই কর্মকাণ্ডও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
কিছু ক্ষেত্রে এই কর্মীরা ডেটা চুরি ও হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায়ের মতো অপরাধেও জড়িয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে ১৪ জন উত্তর কোরীয়র বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে, যারা ছয় বছরে প্রায় ৮৮ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে। চলতি বছরের জুলাইয়েও আরও চারজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়।
জিন-সু জানান, পরিচয় গোপন রাখতে তারা ইউরোপীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ করে অর্থের বিনিময়ে তাদের পরিচয় ব্যবহার করতেন। “প্রোফাইলে এশিয়ান চেহারা থাকলে চাকরি পাওয়া সম্ভব নয়,” বলেন তিনি।
তারা সাধারণত ১০ জনের দল হিসেবে কাজ করতেন। প্রতিদিনের যোগাযোগ হতো স্ল্যাকের মতো প্ল্যাটফর্মে, যা ছদ্মবেশে কাজকে সহজ করত। জিন-সু বলছেন, মার্কিন বাজারে বেতন বেশি হওয়ায় তারা সেখানেই বেশি মনোযোগ দিতেন।
এইসব কর্মকাণ্ড থেকে পাওয়া অর্থ সংগ্রহ করা হতো পশ্চিমা দেশ ও চীনে থাকা একটি সহযোগী নেটওয়ার্কের মাধ্যমে। এমনকি একজন মার্কিন নারীকে উত্তর কোরিয়ান কর্মীদের সাহায্যের অভিযোগে ৮ বছরের বেশি কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
বিবিসি এই তথ্যগুলো স্বাধীনভাবে যাচাই করতে না পারলেও, উত্তর কোরিয়ার মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা সংস্থা ও অন্যান্য পালিয়ে আসা কর্মীদের বক্তব্যেও এই চিত্র উঠে এসেছে।
সাইবার সিকিউরিটি প্রতিষ্ঠানগুলোর মতে, চাকরি প্রক্রিয়ায় অনেক প্রার্থীকে তারা সন্দেহজনক মনে করেছেন। কেউ কেউ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে নিজের চেহারা লুকাতে চেয়েছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।
উত্তর কোরিয়া কয়েক দশক ধরে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের জন্য বিদেশে শ্রমিক পাঠিয়ে আসছে। জিন-সু বলেন, চীনে কাজ করার সময় তাদের চলাফেরায় কড়া নিয়ন্ত্রণ থাকত। বাইরে যেতে দেওয়া হতো না। তবে আইটি কর্মীরা কিছুটা স্বাধীনতা পেতেন।
তিনি বলেন, বিদেশে থাকলে বাস্তব জগৎ বোঝা যায়, তখন বোঝা যায় যে উত্তর কোরিয়ার ভিতরে কিছু একটা গলদ আছে। তবুও, অধিকাংশ আইটি কর্মী দেশত্যাগের চিন্তা করে না। তারা আয়ের সামান্য অংশ রেখে বাকিটা দেশে পাঠিয়ে দেয়।
চীন থেকে পালিয়ে এসে এখন নতুন জীবনে পা রেখেছেন জিন-সু। তিনি এখনো আইটি পেশায় আছেন, তবে ভুয়া পরিচয় নয়, নিজ পরিচয়েই কাজ করছেন। আয় আগের তুলনায় কম হলেও এখন নিজের উপার্জন নিজের কাছে রাখতে পারছেন।
তিনি বলেন, “আগে অবৈধভাবে টাকা রোজগারে অভ্যস্ত ছিলাম। এখন আমি ন্যায্যভাবে পরিশ্রম করে আয় করি, যেটা আমার প্রাপ্য।”
তথ্যসূত্র: বিবিসি