
আজ ইতিহাস বদলে দেওয়া জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্ণ হলো। ২০২৪ সালের এই দিনে দেশজুড়ে জেগে উঠেছিল ছাত্র-জনতা। সরকারবিরোধী গণজোয়ারের মুখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগ করেন, যার মধ্য দিয়ে শেষ হয় দীর্ঘ ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসন। এ দিনটিকে অনেকে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ হিসেবেও আখ্যায়িত করে থাকেন।
সরকারি চাকরিতে কোটাভিত্তিক নিয়োগ বাতিলের দাবিতে ছাত্রদের আন্দোলন যে রূপ নেয় গণ-অভ্যুত্থানে, তাতে এক হয় দেশের সাধারণ জনগণও। রক্ত আর প্রাণের বিনিময়ে ফিরিয়ে আনতে চায় গণতন্ত্র। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চোখও সেদিন ছিল বাংলাদেশের দিকে—একটি জাতি কীভাবে টিকলো অস্ত্রের মুখে, কীভাবে বুক পেতে দিল নির্ভয়ে।
আন্দোলনের মূল প্রেরণা ছিল বছরের পর বছর ধরে জনগণের ওপর চালানো দমন-পীড়ন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, মতপ্রকাশে বাধা, নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বাস্তব অভিজ্ঞতা। ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর চালানো সহিংস দমন কর্মসূচি তার জ্বলন্ত উদাহরণ। কিন্তু সেই জাতি, যাদের রক্তে স্বাধীনতার স্পৃহা, তারা অবশেষে রুখে দাঁড়ায়।
চব্বিশের অভ্যুত্থান ছিল দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা ক্ষোভ, বঞ্চনা আর স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে এক জাতীয় বিস্ফোরণ। এটি শুধু একটি রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ছিল না, বরং একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ। ক্ষমতাসীনদের পতনের দাবিতে যখন ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয় দেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলো, তখন আর প্রতিরোধ সম্ভব হয়নি। দেশ-বিদেশে থাকা বহু নাগরিক এই আন্দোলনের প্রচারে, সহায়তায় এবং সাহস জোগাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। সেনাবাহিনীর ভূমিকা এবং দায়িত্বশীল অবস্থানও জাতির স্মৃতিতে থেকে যাবে।
তবে এখনো অনেক প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। শহীদদের নির্ভুল তালিকা, কবর সংরক্ষণ, আহতদের পুনর্বাসন—এসব বিষয়ে দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই বললেই চলে। এতে শহীদদের নাম ইতিহাস থেকে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে। সেই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচারও অনিশ্চিত।
এ অভ্যুত্থান একদিকে যেমন ফ্যাসিবাদের পতনের পথ তৈরি করেছে, অন্যদিকে সমাজ-রাষ্ট্র-শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তনের দাবিকেও জোরদার করেছে। কিন্তু অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, চাঁদাবাজি, দখলদারিত্বের মতো ঘটনাগুলো নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে।
এখনও অনেক ষড়যন্ত্র রয়ে গেছে, পুরনো ফ্যাসিস্ট শক্তিগুলোও সক্রিয়। এমন পরিস্থিতিতে ঐক্যই হতে পারে সামনে এগোনোর একমাত্র পথ। অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন, এবং একটি দায়িত্বশীল সরকার গঠনের মাধ্যমে সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে। এ আন্দোলনের অর্জন যেন হারিয়ে না যায়, সে জন্য প্রয়োজন বৃহত্তর জাতীয় সংহতি ও সুদূরপ্রসারী কৌশল।
জাতির সামনে এখন দুটি পথ—অগ্রগতির আলো কিংবা পুরনো অন্ধকারে ফিরে যাওয়া। এই পথচলায় সঠিক সিদ্ধান্তই হবে আগামী বাংলাদেশের নিয়তি নির্ধারণকারী।