হিমু পরিবহণ বগুড়া এর বিশেষ আয়োজন – অগ্রজের পাশে আমরা
শহরের বুকে অসহায়, নিঃসঙ্গ প্রবীণ নাগরিকদের এক বিশ্বস্ত ঠিকানা সোনাভান বৃদ্ধাশ্রম । প্রবীণ নাগরিকদের নতুন করে বাঁচতে শেখানো হয় এখানে। বৃদ্ধাশ্রমেও আনন্দে থাকা যায়। তার উদাহরণ শেরপুর রোডের গাড়ীদহ রোডের সোনাভান বৃদ্ধাশ্রম ।
প্রতিটা ব্যস্ত দিন ঘড়ির কাঁটা টিকটিক শব্দ করতে করতে শেষ হয়। ক্লান্তি আষ্টেপৃষ্ঠে শরীরে থাবা বসায়। গল্প বই, গান শুনেও খুঁজতে থাকে একজনকেই। তবুও বৃদ্ধাশ্রমের ভিজে যাওয়া বালিশে মুখ গুজে কাটিয়ে দেয় বছরের বাকি দিন গুলো। কিন্তু এই রমজানের বিশেষ দিনটি ওঁনাদের একাকী কাটাতে দিল না ‘ হিমু পরিবহণ এর সদস্যরা। অন্য বৃদ্ধাশ্রমের থেকে একটু আলাদা এই সোনাভান । কারণ দশ বছর আগে শুধুমাত্র আশ্রয়হীন মানুষের জন্যই গড়ে উঠেছিল এই বৃদ্ধাশ্রম ।
মানুষ বড়ো কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও। মানুষ বড়ো কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও। হয়ত এই শব্দগুলোকেই আপন করে নিয়েছিল ডাঃ সামির হোসেন মিশু, তাহমিনা পারভিন শ্যামলী, ডাঃ মনিরুজ্জামান স্বপ্নন ও ডাঃ রিম্মি, ডাঃ সৈকত ও জাকিয়া সুলতানা সুমি, মিল্লাত হোসেন সুমন, তানভির আলম তন্ময়, এনামুল হক, সিক্তা কাজল, মাহমুদুল হাসান, রাকিবুল ইসলাম, আমির খসরু সেলিম ,শুভ ইসলাম , নাইম হাসান , , সহ আরো নাম না জানা কত নাম। এরা সকলেই বয়সে নবীন কিন্তু এ দিনের মাহাত্ম্য খুঁজে পেতে পৌঁছে গিয়েছিল বগুড়া জেলার শেরপুর এলাকার সোনাভান নামক এক বৃদ্ধাশ্রমে ।
সেখানেই এমনি প্রাণান্তকর আনন্দের অপেক্ষায় ছিলেন বৃদ্ধাশ্রমে থাকা কুড়িজন বৃদ্ধা। স্বামী বিনা পুত্রের সংসারে মায়ের জায়গা হয় না। শেষ ঠিকানা হয় বৃদ্ধাশ্রম। বছরের কয়কটা দিন কথা হয় পুত্রের সঙ্গে। বাকি সময় বৃদ্ধাশ্রমের চার দেওয়ালের মধ্যেই কেটে যায় সময়। থেকে যায় ওঁরা সবকিছুর বাইরে। নীলাভ আকাশ কেটে ভেসে যাওয়া মেঘেদের দিকে ঠায় চোখ রাখে। সোনাভান বৃদ্ধাশ্রমে থাকা কুড়িজন বয়জেষ্ঠাদের দেখে ওদের চোখ ভিজে গিয়েছিল।তাহমিনা পারভিন , সামির হোসেন মিশু , মাহমুদুল হাসান , শুভ , রাকিবুল ইসলাম , আমীর খসরু সেলিম, সিক্তা কাজল সকলে মিলে খাওয়ালেন বৃদ্ধাশ্রমের বৃদ্ধ মা বাবা দের ।
এখানেই শেষ হয়নি আরও এক ডিপে ভর্তি খাবার দিয়েছে আরেক বেলা খাওয়ার জন্য। সেই সঙ্গে মিষ্টিমুখ ও খাদ্যদ্রব্য প্রদান অনুষ্ঠান। মানুষ বড় একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও। মানুষ বড় একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও। ছোটবেলা এদের সকলের কেটেছে দাদু অথবা নানুর কাছে এই সব ভালো ভালো কথা শুনেই। আজ তেমনি অভিজ্ঞতায় ভরে উঠেছে মন। সদস্যরা কেউ কলেজ পড়ুয়া কেউ আবার বিশ্ব বিদ্যালয়ে পৌঁছেছে। সেদিনকার কথাই আজ উস্কে দিল মন। দিনের গোটা সময় কিভাবে কেটে গেল বুঝতেই পারেনি । ওদেরকে কাছে পেয়ে মনে জেগেছে ‘আমরাও দশ মাস দশ দিন গর্ভে রেখে সংসারে সন্তান এনেছি। কিন্তু দেখে না ভাত দেওয়া তো দূর। কষ্ট হলেও এদের কাছে পেয়ে শৈশবের কথাই মনে করিয়ে দিল’।
অসহায় বৃদ্ধ–বৃদ্ধাদের ভরসার ঠিকানা এই বৃদ্ধাশ্রমটি। এই বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে গেলে কোনও অর্থ দিতে হয় না প্রবীণদের। শুধুমাত্র নিজেদের অসহয়তার প্রমাণ দিলেই হয়। আশ্রয়ের সঙ্গে আবাসিকদের দেওয়া হয় খাবার, জামাকাপড় এবং নিয়মিত চিকিৎসা পরিষেবা। বর্তমানে ৩০ জন থাকতে পারেন এই বৃদ্ধাবাসে। রয়েছে নিজস্ব ঘরের ব্যবস্থা। জাতি ও ধর্ম নির্বিশেষে পুরুষ, মহিলা এমনকী স্বামী–স্ত্রী একসঙ্গেই থাকতে পারেন এখানে। আশ্রমের দায়িত্বে থাকা বীজন জানালেন, ‘বৃদ্ধদের সময় কাটানোর জন্য করা হয় – বাগান করা, রান্না করা, টাকা–পয়সার হিসেব রাখা–সহ অনেক কাজ আবাসিকরাই করেন।’ এই আশ্রমে প্রায় পাঁচ বছর নিজের পরিবারের কাছ থেকে চলে আসা এক বৃদ্ধ বলে – আগে সন্তানরা তার খোজ নিত এখন আর তারা তাকে দেখতে আসেনা । তাই নিজের সর্বস্ব খুইয়ে ঠাঁই নিয়েছিলেন এই আশ্রমে।
নিজের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রাও চিনতে পারেননি সেইদিন। পরে অবস্থা পরিবর্তন হয়েছে, অনেক আত্মীয় নিজেদের কাছে নিয়েও যেতে চেয়েছে। কিন্তু রাজি হননি সেই দাদু । তাঁর বক্তব্য, ‘স্ত্রী যখন অসুস্থ ছিল তখন এই আশ্রম থেকে যা সাহায্য পেয়েছি কোনওদিন ভুলতে পারব না। তাই ঠিক করেছি কোথাও যাব না। আমৃত্যু এখানেই থাকব।’