টুরিজমশিবগঞ্জ উপজেলা
প্রধান খবর

মহাস্থানগড়ে শতবর্ষ পরও পর্যটকবান্ধব সুবিধার অভাব

মহাস্থানগড়ের বেষ্টনী প্রাচীরের একাংশ। ছবি: ফেসবুক থেকে সংগৃহীত

পুন্ড্রনগরী বা মহাস্থানগড় দেশের সবচেয়ে প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক সাইট। বগুড়ার করতোয়া নদীর পশ্চিম তীরে ২ কোটি ৪৬ হাজার বর্গমিটার আয়তনের এ নগরীতে কবে মানুষের বসতি শুরু হয় তার সঠিক কোনো তথ্য নেই।

তবে প্রত্নতাত্ত্বিকরা নিশ্চিত করেছেন যে, ‘১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের যৌথ খননে পাওয়া মাটির চুলাটি বাংলাদেশে সবচেয়ে প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এবং এ চুলাটি তৈরি করা হয় কমপক্ষে ২ হাজার ৪০০ বছর আগে। মহাস্থানগড়ে পাওয়া প্রায় ২ হাজার ২০০ বছরের পুরোনো বেশ কয়েকটি পাঞ্চমার্ক কয়েন (ছাপাংকিত মুদ্রা), শুঙ্গ আমলের তৈরি নিখুঁত কারুকাজ করা কয়েকটি পোড়ামাটির ফলকসহ আরও অনেক কিছুই প্রমাণ করে এ দুর্গনগরীতে মানুষের বাসবাস শুরু যিশু খ্রিষ্টের জন্মেরও কয়েক শ বছর আগে।’

প্রত্নতাত্ত্বিকরা বলছেন, করতোয়া নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এ নগরীতে বিভিন্ন সময় পাওয়া গেছে মৌর্যপূর্ব, মৌর্য, গুপ্ত, পাল, সেনসহ বিভিন্ন আমলের হাজারও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, যেসব প্রমাণ করে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের বসবাস গড়ে ওঠেনি রাতারাতি। পুন্ড্রনগর বা মহাস্থানগড়কে কেন্দ্র করে আশপাশের এলাকায় যে ২৫টি প্রত্নস্থল রয়েছে তার সবই গুরুত্বপূর্ণ বলে বহু বছর ধরে গবেষক আর দর্শনার্থীরা আসছেন মহাস্থানগড়ে। কিন্তু তাদের জন্য এখনো প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে পারেনি কোনো সরকার। তবে কর্মকর্তাদের দাবি দেশি-বিদেশি দর্শক আর পর্যটকদের চাহিদার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ইতোমধ্যেই উন্নয়নকাজ শুরু হয়েছে।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর জানায়, দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ এ প্রত্নতাত্ত্বিক সাইটটি ১৯১৯ সালে সংরক্ষিত হিসেবে তালিকায় নেওয়ার অনেক আগেই গবেষকরা এ নগরীর ইতিহাস আর ঐতিহ্য জানতে নানা ধরনের গবেষণা ও খনন শুরু করেন। আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া তার লেখা ‘বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ’ বইতে উল্লেখ করেছেন, দুর্গনগরীর মধ্যে খোদার পাথর ভিটায় খনন হয় ১৯০৭ সালে। সম্ভবত দুর্গনগরীতে এটাই প্রথম পরিকল্পিত প্রত্নতাত্ত্বিক খনন। এরপর আরও অনেকবার খনন হয়েছে মহাস্থানগড়ে। কিন্তু প্রত্নস্থলটি সংরক্ষণের তালিকায় নেওয়ার পর প্রথম খনন হয় ১৯২৮ থেকে ১৯২৯ সালের মধ্যে। খনন করেন ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক কে এন দীক্ষিত। তখন খননে পাওয়া যায় দুটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। এরপর খনন করা হয় ১৯৬০-১৯৬১ সালে। খনন করেন ড. নাজিমুদ্দীন আহম্মেদ। ১৯৮০ সালের পর প্রায়ই খনন হয় মহাস্থানগড় ও আশপাশের সাইটগুলোতে। মিলেছে দুর্লভ সব নিদর্শন।

মৌর্য ও গুপ্ত রাজবংশের রাজধানী পুন্ড্রনগরী এখন মহাস্থানগড় নামেই বেশি পরিচিত। সেখানে এখনো মাটির ওপরেই রয়েছে প্রাচীন ইটের তৈরি নানা ধরনের অবকাঠামো। আবার খনন করলেও পাওয়া যাচ্ছে নানা ধরনের শৈলীতে নির্মিত ইটের দেয়াল ও মেঝের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ সব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) ছিলেন মো. আবদুল খালেক। তিনি খননে অংশ নিয়েছেন বগুড়ার মহাস্থানগড়, ভাসুবিহার, বিহারধাপ ও মঙ্গলকোটসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাইটে। খননে মহাস্থানগড়ে মিলেছে প্রাচীন গেট, বিহার এবং ভাসুবিহারে বৌদ্ধ বিহারসহ নানা নিদর্শন। মঙ্গলকোটে পাওয়া গেছে বিপুলসংখ্যক মাটির মূর্তি।

মো. আবদুল খালেক বলেন, ‘৯০-এর দশকে বাংলাদেশ-ফ্রান্স যৌথ খননে পাওয়া মাটির চুলা, নর্দার্ন ব্ল্যাক পলিশড ওয়্যার (এনবিপিডব্লিউ) পাশাপাশি আরও কিছু নিদর্শন আর নানা ধরনের গবেষণা প্রমাণ করে এ দুর্গনগরীতে মানুষের বসতি শুরু হয় যিশু খ্রিষ্টের জন্মেরও বহু বছর আগে।’

ড. মো. শফিকুল আলম প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরে ডিজি হিসেবে প্রায় ৩ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশ-ফ্রান্সের খনন দল ১৯৯৩ সালে যৌথভাবে প্রথম খনন করে দুর্গনগরীর ভেতর উত্তর-পূর্বাংশে। সেখানে বাংলাদেশ দল খননে পায় মৌর্যপূর্ব অবকাঠামোর পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ অনেক নিদর্শন।

ড. মো. শফিকুল আলম বলেন, ‘১৯৯৩ সালে খননের সময় পাওয়া যায় মৌর্যপূর্ব অবকাঠামো, প্রায় আড়াই হাজার বছরের পুরোনো মাটির চুলা ও পোস্ট হোলসহ আরও অনেক কিছু।’ তিনি আরও জানান, মহাস্থানগড়কে কেন্দ্র করে ৭৬ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে রয়েছে বিভিন্ন আমলের বিপুলসংখ্যক প্রত্নতাত্ত্বিক অবকাঠামো ও নিদর্শন। ড. মো. শফিকুল আলম বলেন, ‘পর্যটন খাতকে এগিয়ে নিতে মহাস্থানগড় ও আশপাশের গুরুত্বপূর্ণ সাইটগুলো খনন করে তা সংরক্ষণে উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০০৪ সালে। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হলে দেশি-বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা আরও বাড়ত।’

রাজিয়া সুলতানা মহাস্থান জাদুঘরের কাস্টোডিয়ানের দায়িত্বে আছেন বেশ কয়েক বছর। তিনি জানান, ১৯৬৭ সালে নির্মিত জাদুঘরে বিভিন্ন আমলের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আছে ৮৩২টি । ওই জাদুঘরে আছে যিশু খ্রিষ্টের জন্মের বহু বছর আগে তৈরি মাটির চুলার পাশাপাশি মৌর্য, গুপ্ত, পালসহ বিভিন্ন আমলের নানা নিদর্শন। রাজিয়া সুলতানা বলেন, ‘জুলাই পর্যন্ত এক বছরে মহাস্থানে এসেছেন ২ হাজার ১২৩ জন বিদেশি পর্যটকসহ ৪ লাখ ১০ হাজার দর্শনার্থী, প্রতিবছরই দর্শনার্থী বাড়ছে।’

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালকের দায়িত্বে আছেন এ কে এম সাইফুর রহমান। তিনি জানান, মহাস্থান দুর্গনগরীতে অন্তত ১১টি বসতির প্রমাণ আছে। মহাস্থান জাদুঘর আর দুর্গনগরী দেখতে এমরান হোসেন আসেন লক্ষ্মীপুর জেলা থেকে, তার সঙ্গে ছিলেন আরও কয়েকজন সহকর্মী। তাদের সঙ্গে দেখা হয় জাদুঘর চত্বরে। এমরান হোসেন বলেন, ‘জাদুঘরে রাখা নিদর্শনগুলো সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য নেই, যা আছে তাতে শুধু জানা যায়, কোথায় পাওয়া গেছে আর কোন আমলের। আমার জানা দরকার নিদর্শনটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য আর প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব। কিন্তু সে রকম কোনো তথ্য নেই।’

জয়পুরহাট থেকে এসেছিলেন মো. বোরহান উদ্দীন। তার অভিযোগ, বৃষ্টি হলে দাঁড়ানোর তেমন কোনো জায়গা নেই, বসারও ভালো ব্যবস্থা নেই। তিনি বলেন, ‘এ সাইটে হাজার হাজার দর্শনার্থী আসেন। কিন্তু ভালো কোনো রেস্টুরেন্ট নেই, নেই থাকার নিরাপদ জায়গা, ওয়াশরুমও নেই পর্যাপ্ত।’ মহাস্থান জাদুঘরের কাস্টোডিয়ান রাজিয়া সুলতানা বলেন, ‘দর্শকদের যে পরিমাণ চাপ সে তুলনায় সুযোগ-সুবিধা এখনো তেমন একটা নেই। তবে নারী-পুরুষের জন্য আলাদাভাবে ওয়াশরুম তৈরি করা হয়েছে, আইনি জটিলতার কারণে যদিও এখনো ইজারা দেওয়া যায়নি। কিন্তু ক্যাফেটেরিয়া তৈরি করা হয়েছে, বসার জন্য ইতোমধ্যে বেশ কিছু বেঞ্চ তৈরি করা হয়েছে।’

সূত্র: খবরের কাগজ

এই বিভাগের অন্য খবর

Back to top button