প্রধান খবরবগুড়া জেলা

যমুনায় পানির স্তর কমছে, বাড়ছে মরুকরণ

গত ৩০ বছরের ব্যবধানে বগুড়ার যমুনা নদীর পানির স্তর অন্তত তিন মিটার কমেছে। উজানের দেশগুলোতে নদীতে বাঁধ নির্মাণ করে পানি শাসন নীতিই এর মূল কারণ। ফলশ্রুতিতে যমুনা নদীর বগুড়ার অংশে বিস্তীর্ণ বালুচর মরূরুপ ধারন করছে। এমন পরিস্থিতি বাংলাদেশের উ প্রায় সব নদনদীতে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, স্বাভাবিক পানি প্রবাহ তথা পানির নায্য হিস্যা ছাড়া নদীর প্রাণ প্রকৃতি টিকে রাখা অসম্ভব হয়ে উঠবে।

স্থানীয় বাসিন্দা ও নৌকার মাঝিদের তথ্যমতে, প্রতি বছর শীতকালে নদী শুকিয়ে যায়। এই সময়টায় বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ধুধু বালুচর চোখে পড়ে। এ বছরেও ইতিমধ্যে ধুনট, সারিয়াকান্দি ও সোনাতলার ১১ টি ইউনিয়নের এরইমধ্যে ১২ টি নৌ-পথ বন্ধ হয়ে পড়েছে। ১৪১ চর গ্রামের প্রায় ২ লাখ মানুষ যোগাযোগ করতে নতুন করে দূর্ভোগে পড়েছেন। এ ছাড়া ডুবোচরের কারণে চলমান নৌ-পথ এখন বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের সূত্র বলছে, প্রায় চার হাজার কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের যমুনা নদীর বাংলাদেশ অংশে রয়েছে ২২০ কিলোমিটার। যমুনা নদীতে দিন দিন নাব্যতা সংকট বাড়ছে। এর অন্যতম কারণ উজানের দেশগুলোর বাঁধ নির্মাণ। ভারত ও চিনের অভ্যন্তরে অন্তত ১৪ টি বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে।

এ ছাড়া যমুনা নদীতে দেশে অন্য নদীগুলোর থেকে চর বেশি। বাপাউবোর তথ্য মতে, যমুনা নদীতে ছোট বড় মিলিয়ে অন্তত ২৫০ টি চর আছে। সম্প্রতি এই চরের সংখ্যা বাড়ছে।

সারিয়াকান্দির মথুরাপাড়া পয়েন্টে বাপাউবোর জরিপ মতে জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে যমুনা নদীর পানির স্তর সর্বনিম্ন ১১ দশমিক ১০ মিটার ছিল। মৌসুম ভেদে গভীরতার পার্র্থক্য ছিল ৬ দশমিক ৬৭ মিটার।

২০১০ সালে এই নদীর পানির স্তরের উচ্চতা ছিল ৯.৬৭ মিটার। ২০২৩ সালে হাইড্রোলজি পরিমাপে এই নদীর পানির স্তর পাওয়া গেছে ৮ দশমিক ৭১ মিটার।

নদীর এমন পরিবর্তনের ভুক্তভোগী এখানকার মানুষজন। হাটফুলবাড়ির বালুচরা গ্রামের মাঝি ৬০ বছরের আব্দুল মজিদ। মথুরাপাড়ায় তার মূল বাড়ি। দশ বছর আগে নদীভাঙনের কারণে এদিকে পার হয়ে আসেন। মাঝির পেশা ছাড়তে পারেননি তিনি। কিন্তু বছরের কয়েক মাস বেকার হয়ে থাকতে হয়। শুকনো মৌসুমে নদীতে পানি না থাকায় এই বাস্তবতা মেনে নিয়েছেন।

আব্দুল মজিদ বলেন, বর্ষা ছাড়া অন্য সময় কিছু কিছু জায়গায় নৌকা নিয়ে যাই। তাও নৌকার তলা নদীর বালুতে আটকে যায়। এই বয়সে আর অন্য কোনো পেশায় যেতে পারিনি।

উপজেলার ঘাটগুলোর ইজারাদার, মাঝিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রমত্তা যমুনা নদীতে এক সময় জাহাজ চললেও এখন আর সেখানে ডিঙি নৌকা চলাচল করা কঠিন হয়ে পড়েছে। মাইলের পর মাইল বালু পথ মাড়িয়ে পথ চলতে হচ্ছে। রুগী পরিবহনে দুর্ভোগের শেষ নেই। সময় মতো হাসপাতালে রুগী আনতে না পাড়ায় পথেই মারা যাচ্ছে অনেক রোগী। গর্ভবতী মহিলারা শহরের আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি একমাস পূর্ব থেকেই আশ্রয় নিচ্ছেন।

একাধিক সংবাদ মাধ্যমের বরাতে জানা যায়, ভারত বাংলাদেশ এই দুই দেশের অভিন্ন এই নদীর পানি বন্টনে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু ইন্ধিরা গান্ধির সাথে যে চুক্তির উদ্যোগ নিয়েছিলেন, ২০১১ সালে হাসিনা-মোদি বৈঠকের পর সেই চুক্তির সবকিছু ঠিক হয়ে আছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অনাগ্রহের কারণে সেই চুক্তি এগোয়নি বেশিদূর।
কিন্তু এর প্রভাবে ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশ তথা উত্তরাঞ্চলে নদী এলাকার প্রাণ-প্রকৃতি হুমকির মুখে পড়ছে। প্রতি বছর বন্যা, নদী ভাঙনের শিকার হয়ে বহু মানুষ আবাস ছেড়ে বিভিন্ন এলাকায় স্থানান্তর হচ্ছেন।

উপজেলার কর্নিবাড়ি ইউনিয়নের শনপচা চর গ্রামের আইনুদ্দিনের বসতবাড়ি-জমি বহু আগেই নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে।

তিনি জানান, যতটুকু জমি আছে, সেগুলোতে চাষ করা অনেক কঠিন। শুকনো মৌসুমে যাতায়াত কষ্টের। আর বর্ষার মৌসুমে তো পানিতে ডুবে থাকে।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. শাহরিয়ার রহমান বলেন. শুষ্ক মৌসুম এলেই নদী এমন রুপ নেয়। নদী ড্রেজিং করতে হবে । এজন্য আমি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে কথা বলেছি।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সারিয়াকান্দির উপবিভাগীয় প্রকৌশলী হুমায়ুন কবির বলেন, বাঙ্গালী নদীকে খননের আওতায় আনা হয়েছে। তবে যমুনা নদীতে খননের কোনো প্রকল্প নেই সরকারের কাছে। বিগত সময়ে বিআইডব্লিউটিআই যমুনা নদীর কিছু কিছু অংশে খনন সমীক্ষা চালিয়েছিল। কিন্তু সেটি ফলপ্রসু হয়নি। কারণ যমুনা নদীতে প্রতি বছর কয়েক টন করে পলি জমা হয়। এ জন্য এখানে খনন করা কার্যকরী হয় না।

প্রকৌশলী হুমায়ুন কবির বলেন, আমরা ভাটির দেশ, এখান দিয়ে নদীর পানি গড়িয়ে সাগরে পতিত হবে। কিন্তু উজানের দেশগুলোয় অন্তত ১৩ থেকে ১৪ টি বাঁধ নির্মাণ হয়েছে। তারা পানি ফিল্টারিং করছে। এতে আমাদের এখানে বর্ষার মৌসুমে প্রচুর বন্যা দেখি। আর শুকনো মৌসুমে ধুধু বালুচর।

১৯৯৬ সালে যমুনা নদীর পানির স্তর সর্বনিম্ন ১১ দশমিক ১০ মিটার ছিল। ২০২৩ সালে এই নদীর পানির স্তর পাওয়া গেছে ৮ দশমিক ৭১ মিটার।

এসবের প্রভাবে আগামীতে আমাদের এই যমুনা নদী এলাকায় মরুকরণ পরিস্থিতি হবে বলে ধারণা করা যায়। যার কিছু কিছু এখন থেকেই দেখা যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন হুমায়ুন কবির।

এই বিভাগের অন্য খবর

Back to top button