বগুড়া সদর উপজেলা
প্রধান খবর

ভিসা জটিলতায় প্রায় ৩ বছর ধরে বগুড়ায় আটকে আছেন কঙ্গো নাগরিক


নিজস্ব প্রতিবেদক: ভিসা জটিলতায় দেশে ফিরতে পারছেন না বগুড়ায় আটকে পড়া কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের নাগরিক ভিটো বলি বোঙ্গেঙ্গে।


ভিটোর দাবি, তাকে আটকে রাখা হয়েছে একটি বাড়ির মধ্যে। কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, ভিটো প্রায় প্রতিদিনই বাজারঘাট ও বিনোদন পার্কে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ভিসা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত ব্যক্তিরা বলছেন, ভিসা জটিলতার মধ্যে পড়েছেন ভিটো। পুলিশও বলছে, ভিটো এখন অবৈধ অভিবাসী হিসেবে রয়েছেন বাংলাদেশে।


ভিটো বর্তমানে রয়েছেন বগুড়া সদর উপজেলার গোকুল পশ্চিমপাড়া গ্রামে। এখানকার বাসিন্দা আতিকুর রহমান পলাশ ‘মায়ের দোয়া’ নামের একটি পাখি আমদানিকারী প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যবসা করেন।
আর ভিটো বলি নিজ দেশ কঙ্গো থেকে পেশায় পাখি রপ্তানি করেন। মায়ের দোয়া প্রতিষ্ঠানের নামে পাখি আমদানি করতে গিয়ে ভিটো বলি বোঙ্গেঙ্গের সাথে পলাশের পরিচয় হয়।


ভিটো কঙ্গোর এভিগামার কিউ-ইলোসুড কালামু কিনসাশা গ্রামের বাসিন্দা। ২০২২ সালের এক নভেম্বর পাখির ব্যবসা সংক্রান্ত আলোচনা করতে বাংলাদেশের বগুড়ায় পলাশের বাড়িতে আসেন ভিটো। ভিসার মেয়াদ ছিল এক মাস। এরপর থেকেই তিনি বগুড়ায় রয়েছেন।


পলাশের দাবি, সাধারণত বিদেশ থেকে পাখি নিয়ে আনার ক্ষেত্রে রপ্তানিকারকদের আমরা ইনভাইট করি। এর আগেও বিদেশি রপ্তানিকারক আমার এখানে এসেছে। পাখি বুঝে দিয়ে তারা চলে যান।


ভিটো যখন আসে তখন পাখি আমদানি-রপ্তানিতে আন্তর্জাতিকভাবে কিছু বিধিনিষেধ দেয়া হয়। এ কারণে নিজের ভিসার মেয়াদের মধ্যে ভিটো পাখি নিয়ে আসতে পারেননি। সেক্ষেত্রে ভিসার মেয়াদের জন্য আবেদন করে সবাই মেয়াদ বাড়িয়ে নেয়। সেটাও খুব সাধারণত বিষয় বলে আমরা জানি। এ জন্যে এটিকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি।’
পাখি আমদানিকারক পলাশ বলেন, পরে কয়েক দফা ভিসার আবেদনের জন্য চেষ্টা করা হয়। বাংলাদেশ থেকে কঙ্গোতে সরাসরি ভিসার জন্য আবেদন করা যায় না। ভারতের মাধ্যমে করতে হয়। এর মধ্যে গত বছরের ৫ আগস্টের পর অনেক কিছু বদলে যায়। এখন তার ভিসা পেতে জন্য অনেক টাকা লাগবে, যেটা ভিটোর কাছেও নেই।


এই আবেদনের বিষয়টি ভিটো বলিও স্বীকার করেন। ইংরেজি ভাষায় তিনি জানান, পলাশের মাধ্যমে দু’বার আবেদনের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু আমি এখনও দেশে যেতে পারছি না। আমি আমার দেশে যেতে চাই।


বগুড়ার গোকুল এলাকায় খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, পাখি ব্যবসায়ী পলাশের বাড়ি গোকুল মেধের উত্তর-পশ্চিম পাশে। পাকা সড়ক থেকে ১০০ মিটার পূর্ব দিকে গেলে পুকুরের পাশে তিন তলা বাড়ি। এই বাড়ির একটি কক্ষে ভিটো বলি বোঙ্গেঙ্গে বর্তমানে বসবাস করছেন। পলাশের বাড়িতে ভিটো জিম্মি হয়ে আছে এমন কথা এলাকার কেউ বলছে না।


কারণ স্থানীয়রা ভিটোকে কখনও ওই বাড়িতে আটকে থাকতে দেখেননি। এলাকায় ঘুরে বেড়াতে দেখেছেন। অনেকের সাথে কথা বলেন। আশেপাশের দোকানে নিয়মিত যান। বেড়াতে গিয়েছেন মমইন ইকোপার্ক, বগুড়া শহরে। বাজারঘাটেও যান নিয়মিতই।
পলাশের চাচাতো ভাই শফিক আহমেদ জানান, ভিটো দু বছরের বেশি সময় ধরে আমাদেরে এখানে আছেন। আমাদের সাথে চলাফেরা করেন। আমাদের সাথে খাওয়া দাওয়া করেন। আবার অনেক সময় নিজেই রান্না করেন। বাজার থেকে মুরগি কিনেন। তাকে কখনও বন্দি অবস্থায় রাখা হয়নি। আমরা একসাথে চলাফেরা করলেও আলাপ খুব একটা হয় না। তার ভাষা না বোঝার জন্য।


একই এলাকার আবু সাইদ নামে এক সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালক জানান, পলাশের এখানে ব্যবসায়িক কাজে ভিটো এসেছেন। এটা সবাই জানে। আমার সাথে ভিটোর নিয়মিত দেখা হয়। আমার অটোরিকশায় চড়ে তিনি মমইন, বগুড়া শহরে ঘুরে বেড়িয়েছেন। কখনও তাকে মনে হয়নি তিনি জিম্মি হয়ে আছেন।


পলাশের কাছে জানা যায়, তারা মূলত কনভেনশনের ‘সংরক্ষণ তালিকা’য় নেই এমন পাখি বা যেসব পাখি বিপন্ন নয় এমন পাখি আমদানি করে থাকেন। এ ধরনের পাখিদের সংক্ষেপে ‘নন সাইটিস’ পাখি বলা হয়।


পাখি আমদানিকারক পলাশ বলেন, ভিটো দেশে আসার পর যে পাখি দেয়ার কথা, সেটি দিতে পারেননি। এভাবে কয়েক দফা পাখি দেয়ার কথা বলেও চাহিদা মোতাবেক দিতে পারেনি ভিটো। এসব আমদানির প্রতিটির প্রকৃত কাগজপত্র আমার কাছে আছে। একবার মাত্র ছয়টা পাখি এনে দিয়েছে। এর জন্য আমাকে ২৩০০ ডলার শুল্ক দিতে হয়েছে। কারণ এলসিতে (লেটার অব ক্রেডিট) যে পরিমাণ আমদানির সংখ্যা থাকবে তার সবটুকুর শুল্ক দিতে বাধ্য আমি। এ জন্য আমার লোকসান আমি মেনে নিয়েছি। তারপরেও সে আমার কাছে টাকা দাবি করে। ভিটো বলে আমার কাছে নাকি পাখির মূল্যবাবদ ১২০০ ডলার পাবে। আমি সেটিও মেনে নিয়েছি।


ভিটোকে জিম্মি করে রাখার অভিযোগের বিষয়ে পলাশ বলেন, আমি তাকে কোনোভাবে আটকে রাখিনি। সে এখনও আমাদের সাথেই থাকে, খায়। তাকে সবচেয়ে ভালো ঘর দেয়া হয়েছে। আমি তাকে বলেছি, ইউ হ্যাপি, মি হ্যাপি। আপনি নিজেই তাকে প্রশ্ন করেন।
ভিটোর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “মি মুভ টু মাই কান্ট্রি। হেয়ার নো প্রবলেম ইন বাংলাদেশ। বাট দে ক্লোজড মি পাসপোর্ট। হি সেড, লুক, ওয়েট, ওয়েট। বাট মি নো গো মাই কান্ট্রি। (আমি আমার দেশে যেতে চাই। এখানে কোনো সমস্যা নাই। কিন্তু আমার পাসপোর্ট নেয়া হয়েছে। সে বলে, দেখতেছি, অপেক্ষা করো। কিন্তু আমি আমার দেশে যেতে পারছি না।)”


ভিটো ও পলাশের কাছে জানা যায়, এ বছরে আবার আবেদনের জন্য পাসপোর্ট ও অন্যান্য কাগজপত্র দেয়া হয়েছে। তার পাসপোর্ট ঢাকায় আছে। এটাকে সে বলছে তার পাসপোর্ট আটকে রাখা হয়েছে। ভিটো নিজেও ওই ভিসা এজেন্সির সাথে কথা বলেছে বলে এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন।


ভিসার আবেদনের জন্য লাল্টু হোসেন নামে এক ব্যক্তির সহযোগিতা নেয়া হয়েছে বলে দাবি করছেন পাখি আমদানিকারক পলাশ। লাল্টুর বাড়ি বগুড়ায় হলেও থাকেন ঢাকায়। লাল্টু হোসেনের মাধ্যমেই তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন।


লাল্টু জানান, ভিটোর পাসপোর্ট ভিসার আবেদনের জন্য প্রায় তিন মাস আগে আমার কাছে দেয়া হয়েছে। এরপর আমি হাইকমিশনে যোগাযোগ করি। কিন্তু তার ভিসার মেয়াদ অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। আবার ৫ আগস্টের পর এই কাজগুলোয় কিছু জটিলতা দেখা দিয়েছে। এ জন্য ভিসা পেতে সমস্যা হচ্ছে। কঙ্গোর ওই ব্যক্তির পাসপোর্ট মোটেও আটকে রাখা হয়নি।


পুলিশ ও পাখি ব্যবসায়ী পলাশের কাছে জানা যায়, গত ১৮ সেপ্টেম্বর পলাশের বাড়ি থেকে আরেক পাখি ব্যবসায়ীর সাথে বের হন ভিটো। ওই পাখি ব্যবসায়ীকে সঙ্গে নিয়ে বগুড়া সদর থানায় গিয়ে লিখিত অভিযোগ করেন।


অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেন, পলাশ ভিটোকে আটকে রেখেছেন। স্থানীয় পাখি ব্যবসায়ী পলাশ আমার পাসপোর্টসহ কাগজপত্র সব আটকে রেখেছেন। এ বিষয়ে আইনগত প্রতিকার চান তিনি।
এ বিষয়ে বগুড়া অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) হুসেইন মোহাম্মদ রায়হান জানান, পুলিশ বিষয়টি নিয়ে খোঁজখবর করেছে। ভিটো নামে কঙ্গোর ওই নাগরিকের ভিসার মেয়াদ যেহেতু নেই। তাই বাংলাদেশে তিনি এখন অবৈধ অভিবাসী। তাকে এখানে রেখে বরং পাখি ব্যবসায়ী পলাশ আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।


করনীয় প্রসঙ্গে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বলেন, এখন এ বিষয়টি নিয়ে আমরা মন্ত্রণালয়ে কথা বলছি। ভিটোকে প্রথমে আমরা কোনো একটা সেফহোমে নেয়ার চেষ্টা করব। পরে রাষ্ট্রীয়ভাবে তাকে তার দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে।

এই বিভাগের অন্য খবর

Back to top button