
অতিরিক্ত ও নিয়ন্ত্রণহীন অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে ব্রয়লার বা পোলট্রি মুরগিতে দ্রুত বাড়ছে মাল্টিড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া, যাকে বলা হয় ‘সুপারবাগ’। এই ব্যাকটেরিয়া মানুষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জীবনরক্ষাকারী অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা কমিয়ে দিচ্ছে। একই সঙ্গে পোলট্রি বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা পরিবেশেও বড় ধরনের হুমকি তৈরি করছে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে পরিচালিত সাম্প্রতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে এসব উদ্বেগজনক তথ্য। গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে ‘এশিয়ান-অস্ট্রালাশিয়ান জার্নাল অব ফুড সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি’তে। গবেষণায় দেখা যায়—দেশের মোট ব্রয়লার উৎপাদনের ৭০–৮০ শতাংশ আসে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারিদের কাছ থেকে, যাদের অধিকাংশই ভেটেরিনারি চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই মুরগিকে ওষুধ দেন। অনেক ক্ষেত্রে ফিড ডিলার বা ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের ‘সুরক্ষা’ পরামর্শে রোগ হওয়ার আগেই মুরগিকে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানো হয়।
সিপ্রোফ্লক্সাসিন, এনরোফ্লক্সাসিন ও টেট্রাসাইক্লিনের মতো ওষুধের ব্যাপক অপব্যবহারে মুরগির মাংসে সহনীয় সীমার চেয়ে বেশি ওষুধের অবশিষ্টাংশ পাওয়া যাচ্ছে। বাজার থেকে সংগৃহীত নমুনার ২২ শতাংশে পাওয়া গেছে ফ্লোরোকুইনোলোন এবং ১৮ শতাংশে টেট্রাসাইক্লিনের অবশিষ্টাংশ। দেশের বিভিন্ন পোলট্রি খামার থেকে সংগ্রহ করা ই. কোলাই নমুনার ৭৫ শতাংশের বেশি ছিল মাল্টিড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট। আরও উদ্বেগের বিষয়—মুরগির অন্ত্রে পাওয়া গেছে ‘এমসিআর–১’ জিন, যা কোলিস্টিন নামের গুরুত্বপূর্ণ অ্যান্টিবায়োটিককে অকার্যকর করে দেয়। খাদ্যের মাধ্যমে মানুষের শরীরে দীর্ঘদিন অল্পমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক প্রবেশ অ্যালার্জি, অঙ্গপ্রতঙ্গের ক্ষতি এবং অন্ত্রের মাইক্রোবায়োম নষ্টের মতো গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
পোলট্রি বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাও পরিবেশের ওপর বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করছে। গবেষণায় বলা হয়েছে—একটি ব্রয়লার তার জীবনচক্রে ১.৫ থেকে ২ কেজি বর্জ্য ত্যাগ করে। দেশে বছরে ২০০ মিলিয়নের বেশি মুরগি উৎপাদিত হয়, যার বিপুল পরিমাণ বর্জ্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপরিশোধিত অবস্থায় জমি ও জলাশয়ে ফেলা হয়। এতে ভূগর্ভস্থ পানি ও নদীনালায় নাইট্রেট–ফসফরাস মিশে পানি দূষিত হয় এবং অ্যামোনিয়া গ্যাস নিঃসরণ ঘটে।
অধ্যাপক ড. মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ব্রয়লারশিল্প দেশের প্রোটিন নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থানে বড় ভূমিকা রাখলেও অ্যান্টিবায়োটিক সংকট পুরো খাতকে ঝুঁকিতে ফেলছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় ‘ওয়ান হেলথ’—মানুষ, প্রাণী ও পরিবেশের সমন্বিত স্বাস্থ্যনীতি—বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। তার মতে, অ্যান্টিবায়োটিকের বিকল্প হিসেবে প্রোবায়োটিক–প্রিবায়োটিকের ব্যবহার বাড়ানো, বায়োসিকিউরিটি জোরদার, টিকাদান নিশ্চিত, নিরাপদ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং সরকারের কঠোর নীতি প্রয়োগ এখন অত্যাবশ্যক।
তিনি আরও বলেন, সময় থাকতে সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া গেলে ব্রয়লারশিল্পকে নিরাপদ, লাভজনক ও টেকসইভাবে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে। আজকের সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করবে আগামী প্রজন্ম কতটা নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য পাবে।



