বগুড়া জেলা
প্রধান খবর

কোটি টাকার আলু হিমাগারে, দিন কাটে লোকসানের শঙ্কায়

হিমাগারে আলু

আসাফ-উদ-দৌলা নিওন: দাম না থাকায় বগুড়ার হিমাগারগুলো থেকে আলু বের করছেন না ব্যবসায়ীরা। লোকসানের শঙ্কায় অনেকে হিমাগারে যোগাযোগও বন্ধ করে দিয়েছে। আর কোটি টাকার এসব আলুর ভাড়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন হিমাগার মালিকরা।


বগুড়ার সদরের মানিকচক এলাকায় খন্দকার বীজ হিমাগারে খোঁজ নিয়ে এমন তথ্য জানা যায়। এই হিমাগারে ৭ হাজার বস্তা আলু সংরক্ষণ করেছেন জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার পুনট এলাকার বাসিন্দা বিষ্ণু মালী। প্রায় এক কোটি টাকার আলু সংরক্ষণ করে এখন কিছুটা ফেরারি জীবন যাপন করছেন তিনি।


হিমাগার মালিক মো. শাহাদত হোসেন সাজু জানান, হিমাগারের ভাড়া কিংবা এই ৭ হাজার বস্তার আলুর কী হবে তা নিয়েই সংশয়ে আছেন। কারণ, বিষ্ণু মালী বগুড়ার খন্দকার বীজ হিমাগারের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছেন। তার দেওয়া মোবাইল নম্বরে কারও সাথে যোগাযোগ করছেন না।


হিমাগার মালিকের কাছে থেকে সংগ্রহ করে ওই নাম্বারে কল দেয়া হলে কেউ রিসিভ করেননি।


বগুড়ার খন্দকার বীজ হিমাগারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহাদত বলেন, এবার সংরক্ষণ মৌসুমে প্রতি আলুর দাম ছিল ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা। এর সাথে রয়েছে হিমাগারে সংরক্ষণ খরচ। বর্তমান বাজারে আলুর যে দাম তাতে প্রতি বস্তায় কৃষক বা ব্যবসায়ীরা ২০০ থেকে ১৫০ টাকা ফেরত পাচ্ছেন। প্রায় ৮০ শতাংশের বেশি লোকসানে রয়েছেন তারা। বর্তমানে ১০ টাকা কেজি আলু কেনার লোকও নেই।


‘এই অবস্থায় হিমাগার মালিকেরাও সংশয়ে রয়েছেন; কারণ ব্যবসায়ী বা কৃষকরা যদি হিমাগার থেকে আলু না নেন তাহলে ভাড়ার টাকা কীভাবে আসবে? যোগ করেন শাহাদত।
কৃষি বিপনন অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বগুড়া ও জয়পুরহাট মিলিয়ে ৫৬টি হিমাগারের মধ্যে বগুড়ায় রয়েছে ৩৭টি। আর জয়পুরহাটে ১৯টি। হিমাগার সংশ্লিষ্টরা জানান, অন্যান্য বছরে এই সময়ে কোল্ড স্টোরের প্রায় ৭০ শতাংশ আলু বিক্রি হয়েছিল। বর্তমানে ৪০ শতাংশেরও কম বিক্রি হয়েছে।

বিষ্ণু মালীর চেয়ে কিছুটা ‘ভালো’ অবস্থানে রয়েছেন বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলার কুন্দারহাট এলাকার বাসিন্দা আব্দুল হালিম। তবে তিনিও ১৬ লাখ টাকা লোকসানে। গত ১২ বছর ধরে আলু ব্যবসা করে আসা হালিম জানালেন, এবারে তিনি ২০ লাখ টাকার আলু সংরক্ষণ করে ৪ লাখ টাকা ফেরত পেয়েছেন। ২৩ থেকে ২০ টাকা কেজি দলে আলু কিনে বিক্রি করেছেন ৯ থেকে ১০ টাকা করে। সাথে অন্যান্য খরচও রয়েছে।


হালিম ব্যবসায়ী হলেও নিজে আলু চাষাবাদ করেন। গত মৌসুমে ২৬ বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছিলেন। লোকসানের কারণে পুঁজি হারিয়ে আগামী মৌসুমে মাত্র ১০ বিঘা জমিতে আলু চাষের চিন্তা করছেন। জানালেন, বাকী জমিতে এবার ধানের আবাদ করবেন।
কৃষি বিভাগের সূত্র বলছে, গেলো মৌসুমে বগুড়ায় ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে প্রায় ১৩ লাখ টন আলু উৎপাদন হয়, যা জেলার চাহিদার তুলনায় প্রায় ৭ লাখ টন বেশি। বিপুল পরিমাণ আলু হিমাগারে পাশাপাশি কৃষকের ঘরে সংরক্ষণ করা আছে।


কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি কেজি আলু উৎপাদনে কৃষকের খরচ প্রায় ১৪ টাকা। হিমাগার ভাড়াসহ অন্যান্য খরচ মিলিয়ে কেজিতে খরচ দাঁড়ায় ২৪ থেকে ২৫ টাকা।
তবে আবহাওয়ার কারণে কৃষকের ঘরে অনেক আলু পচে নষ্ট হয়েছে।


বগুড়ার শেরপুরের কৃষক আলী আজগর জানান, সরকার আলুর দাম ২২ টাকা নির্ধারণ করলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। নেই কোনো তদারকি ব্যবস্থা।


মাথাইল চাপর গ্রামের কৃষক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, গত বছর আলুর দাম বেশি থাকায় সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণ করেছিল। কিন্তু এবার লোকসান ঠেকাতে কোনো নজরদারি নেই। এই কৃষক ১০০ বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছেন। প্রতি বিঘা জমিতে গড়ে ৬৫ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ হয়েছে। প্রতি বিঘাতে ৯০ মণ থেকে ১২০ মণ আলুর উৎপাদন হলেও দাম কম হওয়ায় কোন্ড স্টোরেজে রেখেছেন। কিন্তু ৬ মাস পেরিয়ে গেলেও আলুর দাম নেই। অর্ধেক মুলধন ফেরত পাবেন কিনা, শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।


বগুড়ার শেরপুর উপজেলার এগ্রো আর্ট ইন্ডাস্ট্রি এন্ড কোল্ড স্টোরেজ লিমিটেড ব্যবস্থাপক আব্দুর রশিদ বলেন, গত বছর এই সময়ে হিমাগারে আলুর রমরমা বেচাকেনা হয়েছে। কিন্তু এবারের চিত্র উল্টো। দাম না থাকায় কৃষকরা হিমাগারে আলু নিতে আসছেন না। ৬ মাস অতিবাহিত হলেও বাজার দরপতনে ৭০ শতাংশ আলু হিমাগারেই আছে।


হিমাগার মালিক ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, আলু উৎপাদনে আসলে সরকারের কাছেও সঠিক হিসাব নেই। অনুমান নির্ভর হিসাবের কারণে বর্তমানে কৃষকদের এমন দুর্দশা। এবার হাজার হাজার আলু ব্যবসায়ী ও কৃষক নিঃস্ব হয়ে যাবেন। এ ছাড়া তরকারি হিসেবে খাওয়া ছাড়া আলুর ভিন্ন ব্যবহারের ক্ষেত্র তেমন বিকশিত হয়নি। রপ্তানির ক্ষেত্রেও সরকারের কোনো কার্যকরী ভূমিকা নেই। এ কারণে অতিরিক্ত উৎপাদন হলে সেই আলুর কোনো ভবিষ্যৎ থাকে না।


আলু নিয়ে দিশেহারা এমন পরিস্থিতিতে বিশেষ কোনো পরিকল্পনা নেই। তবে বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সোহেল মো. শামসুদ্দিন ফিরোজ বলেন, সম্প্রতি মন্ত্রনালয় থেকে জেলার কৃষি কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে। সরকারি আলু ক্রয় করার উদ্যোগ নিয়েছে। বিগত সময়ে আলুর দাম কেজি প্রতি ২২ টাকা করে দেয়ার কথা উঠেছিল। এখন সরকার সেই ২২ টাকা করে দিবে নাকি হিমাগারের ভাড়ার মূল্য বাবদ দেয়া হবে সেটি নিয়ে আলোচনা চলছে।

এই বিভাগের অন্য খবর

Back to top button